কী ভাবে পরিচালনা করতে হবে
- ১) প্রথমেই ক্লাসে একটি সুস্থ আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে তার মাধ্যমে এই কার্যক্রমের বিষয়বস্তু’টি স্থির করে নিতে হবে। নির্বাচিত বিষয়বস্তু’টি এমন হতে হবে যাতে সেই বিষয়ে শিশুদের আগ্রহ থাকে এবং তারা যাতে বর্তমান পরিস্থিতি ও নিজেদের জীবনে এটির প্রাসঙ্গিকতা সহজেই বুঝতে পারে।
- ২) বিষয়বস্তু নির্বাচিত হয়ে গেলে শুরু হবে মাইন্ড ম্যাপিং অনুশীলন। নির্বাচিত বিষয়বস্তু সম্পর্কিত যাকিছু শব্দ শিশুদের মনে আসবে সেইগুলিকে শিক্ষক আহ্বান করবেন। সেই সমস্ত শব্দের সম্পূর্ণ তালিকা সামনে বোর্ডে লেখা যেতে পারে। এইটি শিশুদের সুযোগ করে দেয় তাদের নানান সৃজনমূলক চিন্তা প্রকাশ করতে। তালিকায় নথিভূক্ত হওয়া কিছু শব্দ হয়তো শিক্ষকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক অথবা অদ্ভুত লাগতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই সেইগুলি কোন প্রকার পাঠ্যবই বা পাঠ্যক্রম দ্বারা আবদ্ধ নয়। তবুও শিশুদের চিন্তাধারা বা উপলব্ধিগুলি সানন্দে গ্রহণ করতে হবে।
- ৩) মাইন্ড ম্যাপিং অনুশীলনটি একটি সন্তোষজনক স্তরে পৌঁছলে এরপর শুরু হয় একটি ওয়েব চার্ট বানানোর প্রক্রিয়া। ওয়েব চার্ট-এর একেকটি অংশ হলো একেকটি ভাগে বিভক্ত এক গোছ শব্দ। এইটি নানান প্রসঙ্গোচিত শব্দ ও তাদের ঘিরে সম্ভাব্য কার্যক্রম গুলির একপ্রকার রূপরেখা টানে বা নকশা বহন করে। সাধারণত দেখা যায় যে অঙ্ক, বিজ্ঞান , সামাজিক শিক্ষা ও ভাষাগত শিক্ষার মতন বিষয় গুলিকেই শব্দের একেকটি ভাগ বা গ্রুপ হিসেবে শিশুরা বেছে নেয় কারণ সেইগুলির এক সুনির্দিষ্ট পাঠ্যধারা বা বিষয়বস্তু থেকে থাকে।
- ৪) ওয়েব চার্ট তৈরি করার সময় সবচেয়ে ভালো হয় যদি শিশুরা ছোট ছোট দল আকারে গোল হয়ে বসে। তাতে তাদের চিন্তাধারা গুলি তারা সহজেই খোলামেলা ভাবে আদান-প্রদান করতে পারে। শুরুতে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে যে শিশুরা অধিক মাত্রায় বা প্রয়োজনের চেয়ে উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কিন্তু নিজেদের কার্যে মনোনিবেশ ঘটিয়ে শিশুরা যতই তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগোবে ক্রমে ততই তাদের আচরণে এক প্রকার শৃঙ্খলা বোধ ও মার্জন লক্ষ্য করা যাবে।
- ৫) এরপর সবাই এই গ্রুপ গুলির ব্যাপারে তাদের মতামত ও চিন্তাধারা ভাগ করে নিতে পারে। প্রথমদিকে ওয়েব চার্ট’টি অত্যাধিক বড় বিস্তারিত বা জটিল লাগতে পারে। পর্যায়ক্রমে শিশুদের মনে হতে পারে যে তাদের চিন্তাভাবনায় নানান যোগসুত্র বাদ পড়ে গেছে। যদিও এই পর্যায়ে শিশুদের কোনরকম সুস্পষ্ট নির্দেশ বা প্রত্যক্ষ পরামর্শ দেওয়া যাবে না, কিন্তু শিক্ষক দক্ষতার সাথে পরোক্ষভাবে শিশুদের সহায়তা করবে যাতে তাদের উপস্থাপনায় সংহতি বজায় থাকে। শিক্ষকের উচিত শিশুদের আগ্রহের উপর ভিত্তি করে তেমন কিছু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু চিহ্নিত করা ও সে বিষয়ে শিশুদের কী করনীয় তা ধরিয়ে দেওয়া।
৬) ওয়েব চার্ট’টি বানানো হয়ে গেলে গোটা ক্লাস’টি কে বিভিন্ন গ্রুপ-এ বিভক্ত করতে হবে, যার একেকটি তে ৫ থেকে ৬’জন শিশু থাকবে। প্রতিটি গ্রুপ তাদের বিশেষ আগ্রহ অনুযায়ী ওয়েব চার্ট থেকে একটি করে অংশবিশেষ বেছে নেবে কাজ করার জন্য। কোন বিশেষীকরণ কে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষকের উচিত শিশুদের কে এমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজে নিযুক্ত করা যাতে প্রত্যেকটি শিশুই সুযোগ পায় তাদের সব রকম দক্ষতা গুলি প্রশিক্ষণ করার।
এবার তারা সবরকম সম্ভাব্য কার্যক্রমের তালিকা তৈরি করতে শুরু করবে। এটি মূলত নির্ভর করবে শিশুদের বিশেষ গুণ ও দক্ষতার উপর। এই কার্যক্রমের নানান দিক থাকে যেমন ভাষাগত দক্ষতা (গান, কবিতা , নাটক লেখা, ইত্যাদি), গণিত সম্বন্ধীয় দক্ষতা (মাপজোক, মানচিত্র, হিসেব-নিকেশ, ইত্যাদি), সৃজনশীলতা (অংকন, হাতের কাজ, সঙ্গীত, অভিনয়), কথোপকথন বা ভাব প্রকাশে পারদর্শিতা (সাক্ষাৎকার, গল্প বলা, বক্তৃতা, রচনা)। সম্পূর্ণ এক্সপেরিয়েন্শিয়াল লার্নিং প্রক্রিয়ার সময়সীমা ৬ থেকে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত বিস্তারিত হতে পারে। বেশিরভাগ স্কুলেই শিক্ষাক্রম নির্ধারণ, বিষয় নির্বাচন, ইত্যাদি ব্যাপারে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হয় না। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের উচিত দৃঢ়তার সাথে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের এই শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া।
- ৭) অনুশীলন’টি সুসম্পন্ন হলে, অন্যান্য ক্লাস, অভিভাবক ,বা অতিথিবৃন্দের কাছে সেগুলি উপস্থাপন করার সুযোগ করে দিয়ে শিশুদের আরও উৎসাহ প্রদান করা যায়। আকর্ষণীয় চার্ট মডেল সংগীত মজার খেলা গল্প নাটিকা ইত্যাদি দ্বারা উপস্থাপনাটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী করে তোলা যায়। সম্পূর্ণ উপস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তবেই নতুন কোন বিষয় নিয়ে এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং পুনরায় পরিচালনা করা যায়।
শিক্ষক /শিক্ষিকার ভূমিকা
এই সমস্ত ব্যাপারে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । তাঁকে সব সময় প্রধান উদ্দেশ্যগুলির কথা মনে রাখতে হবে ।
শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক হচ্ছেন ,,,, Friend , Philosopher & Guide..অর্থাৎ তিনি তাদের কাছে একজন বন্ধু হিসেবে থাকবেন -যাতে তারা সহজে তাঁর কাছে আসতে পারে , তাদের সব কথা বলতে পারে এবং নানা ভাবে উৎসাহিত হতে পারে ।
তিনি তাদের কাছে একজন উপদেষ্টাও , অর্থাৎ কোনো রকম প্রভুত্ব বা আধিপত্য বিস্তার না করে তিনি যত্ন সহকারে বিভিন্ন মতামত দেবেন এবং সদর্থক আলোচনা ও প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে সঠিক পথ দেখাবেন।
তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে Philosopher অর্থাৎ দার্শনিক কারণ শিক্ষকের উপস্থিতি , তাঁর বক্তব্য ও মতামত ছাত্রছাত্রীদের এতটা প্রভাবিত করবে যে তখন তারা শিক্ষার আসল মূল্যটি বুঝতে পারবে ।
ছোট শিশুরা যারা এখনো ভালো করে লেখার বা কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেনি , তাদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক activity র পর প্রশ্নোত্তর আলোচনা অবশ্যই প্রয়োজন । কি তারা করল , কি নতুন তারা জানল এবং কি সিদ্ধান্তে তারা পৌঁছাতে পারল – শিক্ষার্থীদের বর্ণনা করতে হবে । পূর্বেই বলা হয়েছে – পরীক্ষামূলক শিক্ষা একটি পাঠক্রমে প্রবেশের অভিমুখ ; কোনো বিশেষ বিষয়ের শিক্ষা নয় । ফলে সিলেবাসের সীমিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে শিক্ষককে । এর ফলে তাদের ভাষার ওপর দক্ষতা এবং অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তাদের আত্ম-বিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং আত্মতুষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতে পারবে। শিশুরা যখন তাদের কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেয়ে মগ্ন হয়ে যাবে , যখন তারা বৈচিত্র্যময় ঘটনা সমূহের মধ্যে অন্তর্নিহিত সম্পর্ক ও তাৎপর্য বুঝতে পারবে , যখন তারা যা পর্যবেক্ষণ করল ও শিখল তা সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারবে এবং যখন তাদের চিন্তা , অনুভূতি এবং কাজকে একসূত্রে গ্রন্থিত করতে পারবে –তখনই আমরা আমাদের প্রচেষ্টার সার্থকতায় সন্তুষ্ট হতে পারবো ।
[Source – ‘Towards Human Excellence Sri Sathya Sai Education for Schools’ Book 7, “Experiential Learning” published by Institute of Sathya Sai Education, Mumbai.]