খোরদাদ সাল: নবী জোরাথুষ্ট্রর জন্ম
জোরাথুষ্ট্র ধর্মযাজকীয় স্পিতম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মা ছিলেন ডুগডোভা এবং তার বাবার নাম ছিলো পৌরুশাসপা স্পিতম।তিনি জন্মেছিলেন ব্যাকট্রিয়াতে, ভেবডায়েট নদীর পাশে রী নামে একটি শহরে।দিনটা ছিলো খোরদাদ, ফ্রাভারদিন মাসের (জোরোয়াসট্রিয়ান বছরের প্রথম মাস) ষষ্ঠ দিন। তার জন্মের আগেই তার মা ডুগডোভা স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে স্বপ্ন তার ছেলের দৈব সংকল্পের ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলো। এরকম কথিত আছে যে যখন জোরাথুষ্ট্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার দেহজ্যোতি সমস্ত রী শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ো’ আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো, – মানবকুলের এই প্রার্থনায় সাড়া দিতেই একজন নবী বা ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। এই ঘটনাটি চিহ্নিত করে বা ঘোষণা করে যে একজন যিনি অজ্ঞানতার অন্ধকার নাশ করবেন ও ভালোবাসা ও জ্ঞানের আলো মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেবেন, তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। পিতামাতা সন্তানের নাম দিলেন জোরাথুষ্ট্র যার অর্থ হল সোনালী উজ্জ্বল তারা। ধর্মগ্রন্থগুলি বর্ণনা করেছে এই নবীর জন্মের সময় কিভাবে সমস্ত প্রকৃতি ফলেফুলে প্রস্ফুটিত প্রাণবন্ত ও আনন্দিত হয়ে উঠেছিল এবং প্রতিটি মানুষ ও পশুপাখির হৃদয়ে কতখানি আনন্দ ও ঈশ্বরের আশির্বাদ অনুভূত হয়েছিলো।
একদল দৈত্য ও মায়াবী যাদুকর এই ভেবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরলো যে দিব্য শিশুই তাদের ধ্বংসের কারণ হবে এবং দুরাসারুন নামে তাদের দলনেতা সেই শিশুকে হত্যা করার জন্য নানা রকম পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শিশুটি কিন্তু বেঁচে ছিলো ঈশ্বরের, জ্ঞানের দেবতার দয়ায় ও আশ্রয়ে।
জোরাথুষ্ট্র দিনে দিনে একজন বুদ্ধিমান শ্রদ্ধাশীল ও ঈশ্বরনিষ্ঠ বালকে পরিণত হল। সেই সময় দুরাসারুনের লোকেরা ডাক্তারের ছদ্মবেশে ওষুধের মধ্যে বিষ দিয়ে তাকে মেরে ফেলার শেষ চেষ্টা করেছিলো।কিন্তু জোরাথুষ্ট্র সহজেই তাদের চালাকি বুঝতে পেরে ওষুধ খেতে অস্বীকার করেছিলো।
সাত বছর বয়সে বোরজিন খুর্শ নামে একজন জ্ঞানী মানুষের হাতে তার শিক্ষার ভার তুলে দেওয়া হয়েছিলো এবং তিনি যা কিছু শিখতে পেরেছিলেন তার তত্বাবধানেই শিখেছিলেন। তিনি জোরাথুষ্ট্রকে অভিষিক্ত ও দীক্ষিত করেছিলেন মাজদায়াসনিন (জ্ঞান রূপ আলোকে ঈশ্বর জ্ঞনে বন্দনা) বিশ্বাসে এবং পনেরো বছর বয়সে জোরাথুষ্ট্রকে অর্পণ করা হয় পবিত্র উপবিত বা খুসটি। পঁচিশ বছর বয়সে জোরাথুষ্ট্র অনুভব করলেন যে তার উচিত কোনো নির্জন স্থানে একাকী গভীর ধ্যানে ও ঈশ্বরের মহাজাগতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তায় এবং জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য সন্ধানে মগ্ন হওয়া। সুতরাং জোরাথুষ্ট্র থাকার জন্য পাহাড়ের ওপরে ভেড়াদের আস্তানার কাছে একটি জায়গা বেছে নিলেন। রাখাল বালকেরা জোরাথুষ্ট্রকে ছোট ছোট উপহার, দুধ, রুটি এইসব এনে দিয়ে সাহায্য করতো। এইভাবে জোরাথুষ্ট্র দশ বছর কাটালেন এবং সেখানে থাকাকালীন গাথাস (জোরাথুষ্ট্রর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ) তার চিত্তপটে দৃশ্যমান হয়েছিল। যখন জোরাথুষ্ট্র নিশ্চিত হলেন যে সুন্দর সুষ্পষ্ট ঈশ্বর দর্শন তার হয়েছে, ঈশ্বর রহস্যের উদ্ঘাটন হয়েছে, তখন তিনি পাহাড়ের সেই অঞ্চল ছেড়ে রাজা ভিসটাস্পের রাজসভার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।তিনি তদানীন্তন মাজদায়াসনিন বিশ্বাসের সংশোধনের কাজ শুরু করেছিলেন এবং যখন রাজা ভিসটাস্প জোরাথুষ্ট্রের বাণী ও শিক্ষাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করলেন, ‘জোরাথুষ্ট্রী মাজদায়াসনিন’ বিশ্বাস ইরানের জাতীয় ধর্মের মর্যাদা পেলো।
খোরদাদ সালের (জোরাষ্ট্রীয়ান বছরের প্রথম মাসের ষষ্ঠ দিন) দিন সকল জোরাষ্ট্রীয়ান জোরাথুষ্ট্রর স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং মানব জাতির প্রতি তার শিক্ষা ও উপদেশ অনুসারে জীবন অতিবাহিত করার চেষ্টা করে। জোরাথুষ্ট্রের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে সাতটি আমেসা স্পেনটা অথবা সত্য ধর্ম শান্তি প্রেমের পথ যা জোরাথুষ্ট্র সকলকে শিখিয়েছিলেন।
“সাত আমেশা স্পেনটা” বা “পবিত্র অমৃতকথা”
আমেশা স্পেনটা হল আহুরা মাজদার বিভিন্ন দিক এবং প্রতিটি দিকই ঈশ্বরে উপনীত হবার পথ। প্রথম আমেশা স্পেনটা হল আহুরা মাজদা নিজেই। সেই পরম একজন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বাস করেন। তিনি হলেন প্রতিটি মানুষের অন্তরোস্থিত ঈশ্বর। সব সত্যের মাঝে সেরা সত্য – এই অপরিবর্তিত সত্যকে অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে আমাদের চিন্তায় ও বাক্যে।
দ্বিতীয়টি হল ভোহু মানো বা নিষ্পাপ ভালোবাসায় পূর্ণ মন। ভালোবাসাই ঈশ্বর। সত্যিকারের ভালোবাসা দেয় ও ক্ষমা করে দেয়। আলোর মত ভালোবাসা কোনো সীমানায় বাধা পরে না। ভালোবাসা তুমি যতই বিতরণ কর কখনোই নিঃশেষিত হবেনা। ভালোবাসায় যদি দান ও ক্ষমা না থাকে, তাকে বলা হয় ‘অকো মানো’ অথবা নিকৃষ্ট মন।
তৃতীয়টি হল আশা ভাহিশটা, যার মানে হল সর্বোচ্চ বা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এটা হল জোরাথুষ্ট্রর শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তর বা মূল স্তম্ভ। হৃদয়ে সত্যকে ধারণ করে সবরকম সঠিক কাজ করা ও ধর্ম পালনই এর অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থটি হল ‘আমেশা স্পেনটা’ যা বর্ণিত হয়েছে ‘ভোহু ক্ষাথরাম ভইরাম’ হিসেবে। এর অর্থ হল বহু মূল্যবান, ভালোবাসায় পূর্ণ ঐশ্বরিক শক্তি।এটা হল একটা আশীর্বাদ যা বর্ষিত হয় ‘আশা’ র পথ অনুসরণ করার ফল স্বরূপ। ঈশ্বরের আশীর্বাদে অহং বোধও আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয় ও আমাদের সকল কাজ ঈশ্বরে নিবেদিত প্রেমপূর্ণ অর্ঘ্যে পরিণত হয়, ঈশ্বর, যিনি শুধু মানুষের মধ্যেই রিরাজ করেন না, তিনি রয়েছেন আমাদের চারপাশের পশু পাখি ও সমস্ত জীবজগতের মধ্যে। একজন মানুষ যার সত্যি একটা ভালোবাসায় পূর্ণ হৃদয় রয়েছে সে কখনোই পশুপাখিদের আঘাত করবে না, তাদের ক্ষতি করবে না। আসল কথা, গাথায় ভোহু মানো (প্রেমময় ঈশ্বর) কে বর্ণনা করা হয়েছে প্রাণীজগতের দৈব রক্ষাকর্তা হিসেবে।
বাকী তিনটি আমেশা স্পেনটা বর্ণিত হয়েছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ উপহার হিসেবে যা একজন পেয়ে থাকে আশা বা ধর্মাচারনের মাধ্যমে। স্পেনটো আরমাইটিকে বর্ণনা করা হয়েছে মাজদার কন্যা হিসেবে। সে সূচিত করে জ্ঞান।জ্ঞান থেকেই আসে শান্তি। কারণ জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়েই আমরা সমগ্ৰ সৃষ্টির মধ্যেকার একতাকে উপলব্ধি করতে পারি এবং তখন আমরা জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখ দুঃখ উত্থান পতন দ্বারা আক্রান্ত বা বিচলিত হই না। তারপর ষষ্ঠ ধাপে আমরা অর্জন করি ‘খুরদাদ হাউরভাতাত’ যার মানে হল নিশ্চিত নিরাপত্তার মিষ্টত্ব বা আনন্দ এবং শেষ ধাপ হল আমেরেটাট, ঈশ্বরের সাথে একত্ব অনুভব করা ও অমরত্ব লাভ করা যা হল ঈশ্বরের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদক উপহার।
সত্য ধর্ম শান্তি প্রেম সব ধর্মমতেরই অন্তর্নিহিত নির্যাস এবং যখন আমরা এই চারটির যেকোনো একটির অভ্যেস করি, বাকী তিনটি আপনিই আমাদের মধ্যে চলে আসে।