ঈশ্বরত্বের প্রকাশ
৮ই মার্চ, ১৯৪০ তারিখে উভকোণ্ডার লোকেরা এই শুনে মর্মাহত হয়েছিলেন যে, এক বিরাট কাল রঙের কাঁকড়াবিছে সত্যকে কামড়েছে। যদিও কোনও কাঁকড়াবিছে কিংবা সাপ দেখা যায় নি কিন্তু সত্য অচৈতন্য হয়ে পড়লেন এবং তাঁর শরীর শক্ত হয়ে গেল। সত্যের চিকিৎসার জন্য শেষমা রাজু একজন ডাক্তারকে নিয়ে এসেছিলেন। দুই-একদিনের ভিতর সত্য নিজেকে ভাল করে তুলেছিলেন কিন্তু তারপর তাঁর আচরণ অদ্ভূত হয়ে ওঠে। শেষমা রাজু তৎক্ষণাৎ পুট্টাপর্তীতে তাঁর পিতামাতার কাছে খবর পাঠালেন উড়ভকোণ্ডা এসে সত্যের ভার গ্রহণ করবার জন্য।
আজকের দিনে যদি বাবা আপাতঃ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান তাহলে আমরা জানি যে, দূরের কোথাও কোনও ভক্তকে সাহায্য করবার জন্য তিনি তাঁর দেহ ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা আরও জানি যে ভগবান বাবা কখনও কখনও কোনও ভক্তের রোগ নিজের দেহে নিয়ে নেন, তা না হলে ঐ ব্যক্তি কোনও অসমাপ্ত কাজ করবার জন্য বেঁচে থাকত না।
কিন্তু সত্যের আশেপাশের লোকেরা এ কথা জানত না এবং এ ধরণের ঘটনা ঘটলে তারা ভীত হয়ে পড়ত। এক সপ্তাহ পরে সত্যের পিতামাতা এলেন, কারণ ঐসময় যগাোযোগ ব্যবস্থা খুবই ধীরগতির ছিল এবং তাঁরা এসে যা-দেখলেন এবং শুনলেন তাতে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। কখনও কখনও সত্য খুবই নীরব ও শান্ত থাকতেন, আবার কখনও গান ও কবিতায় মেতে উঠতেন, সংস্কৃতের বড় বড় শ্লোক আবৃত্তি করতেন কিংবা শাস্ত্রের দর্শন ব্যাখ্যা করতেন।
একদিন যখন সত্য বিশ্রাম করেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল, তখন হঠাৎ মন্তব্য করেছিলেন, “পাশের বাড়ীর লোকটি একটি সংস্কৃত বই পুরো ভুলভাবে পড়ছে, সে বইটির ভুল ব্যাখ্যা করছে, যাও, গিয়ে তাকে এখানে ডেকে নিয়ে এসো”, তিনি আদেশ দিলেন। ছোট একটি বালকের এই কথায় ঐ পাঠকটি অত্যন্ত রেগে গিয়ে প্রত্যুত্তরে বলেছিল, “সে কি করে বলতে পারে যে অর্থ সঠিক না ভুল? সে কি করে আমার কথা শুনতে পেল? তাকে বল নিজের চরকায় তেল দিতে”।
কিন্তু সত্য গোঁ ধরে রইলেন এবং পরিশেষে পিতামাতাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য ঐ পাঠক এসেছিল। পিতামাতা তাকে হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করেছিলেন যে, তিনি যেন এসে সত্যকে বিনয় সম্পর্কে উচিত শিক্ষা দেন। ঐ পণ্ডিত এলে, তিনি যে অংশটি পাঠ করছিলেন তা আবার বলতে সত্য তাকে বলেছিলেন। কোথায় তার ভুল হচ্ছে তা সত্য তাকে দেখিয়ে দিলেন এবং তারপর মহাকাব্যের উপর বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, যা পণ্ডিতকে অভিভূত করে দেয় এবং তিনি অবশেষে সত্যের চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করে তাঁর আদেশ সঙ্গে সঙ্গে না মানবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন!
সত্যকে জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক কে দেখানো হলো কিন্তু তাতে কোনও ফল হল না। সত্য ভক্তিগীতি গাইতে এবং ভগবান সম্পর্কে বলে যেতে লাগলেন। তিনি এমন সব তীর্থক্ষেত্রের নাম বলতে লাগলেন যেখানে কেউই কখনো যায়নি। তিনি ঘোষণা করলেন যে, সারা জীবনই হল নাটক! এবং তেমনভাবেই চলতে লাগল। সত্যের কোমল এই আশ্বাস “কেন তোমরা এভাবে দুশ্চিন্তা করছ? কিছুই করবার নেই” সত্ত্বেও পিতামাতা হতাশ হয়ে রইলেন এবং সত্যকে পুট্টাপর্তী’ নিয়ে এলেন।
অজ্ঞানতাবশতঃ কোন রোগ অথবা অজানা কিছুর প্রতি গ্রামবাসীদের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ভয়ংকর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠা। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিতামাতাকে কেউ একজন জানালো যে ব্রাহ্মণপল্লীতে এক শক্তিশালী ওঝা রয়েছে যে সত্যকে খুবই তাড়াতাড়ি ভালো করে তুলতে পারবে। সত্যকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। বিখ্যাত সেই ওঝা সত্যের উপর নানা প্রক্রিয়া ব্যবহার করল। তার মধ্যে ছিল সত্যের মাথা নেড়া করে দিয়ে তার মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে গভীর করে দাগ কেটে দেওয়া। মাথায় যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল তাতে লেবু, রসুন ও অন্যান্য ফলের রস ঢেলে দেওয়া হল। সত্য ধৈর্য্যের সঙ্গে এসব সহ্য করছে দেখে তাঁর বাবা-মা আশ্চর্য হয়ে গেলেন; তিনি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেন নি, এমনকি মুখের কোনও বিকৃতিও হয় নি। অবশেষে অকারণে রেগে যাওয়া লোকটি কতগুলো জিনিস মিশিয়ে সত্যের চোখে লাগিয়ে দিল, যা তাঁর চোখকে যেন জ্বালিয়ে দিল। সত্যের মাথা ও মুখ ফুলে গিয়ে এমন হল যে তাঁকে চেনা যাচ্ছিল না, চোখ দিয়ে অবিরাম জল পড়তে লাগল এবং তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। সত্যের পিতামাতা এবং দিদি ব্যাথায় কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু সত্য সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে ছিলেন। তিনি তাদের ইংগিতে ঘরের বাইরে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। সত্যও ঐ ওঝার অলক্ষ্যে বাইরে চলে এলেন এবং তাঁর জানা একটি ওষুধ পিতামাতাকে আনতে বললেন। তা এনে তাঁর চোখে দেওয়া হল। ফোলা কমে এল এবং বাবা-মার মন একটু শান্ত হল।
পুরো নিপীড়নের সময় সত্য শুধু মৃদু হেসে যাচ্ছিলেন এবং কোনও যন্ত্রণা অনুভব করেন নি, কারণ তিনি কখনই নিজেকে তাঁর শরীরের সঙ্গে চিহ্নিত করেন নি। পরে তিনি তাঁর পিতামাতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “এখন কি আপনাদের বিশ্বাস আনবার জন্য। হঠাৎ একদিন যদি আমি ঘোষণা করতাম তাহলে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কিরূপ হত? কষ্টভোগ, ব্যাথা অথবা আনন্দ কখনো আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না।”
কিন্তু এই সব কষ্টভোগ দেখাটা. পিতামাতার কাছে খুবই বেশী বলে মনে হয়েছিল, তাই পরদিন তারা ঐ ক্রুদ্ধ “ডাক্তার” কে অনেক বক্শিশ দিয়ে শান্ত করে সত্যকে পুট্টাপর্তী নিয়ে এলেন।
এক উকিল-বন্ধু রাজুদের বাড়ীতে এসে সমস্ত কিছু শুনে চিন্তা করে ভেংকাপ্পা রাজুকে বলেছিল, “এটা খুবই মারাত্মক বিষয়, সত্যকে তাড়াতাড়ি করে নরসিংহ অবতারের মন্দিরে নিয়ে যান – এটাই হল শেষ চেষ্টা।” কথাগুলো শুনে সত্য তাকে বলেছিলেন, “মজার কথা! তাই নয় কি? আমিতো মন্দিরে রয়েছি, আর তুমি আমার কাছে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছ?” উকিল নীরবে চলে গেলেন।
২৩শে মে, ১৯৪০ তারিখে চোদ্দ বছর বয়সী সত্য পরিবারের লোকেদের তাঁর চারপাশে ডেকে এনে হাত ঘুরিয়ে মিছরি ও ফুল সৃষ্টি করে তাদের দিলেন। এসব দেখে প্রতিবেশীরা দৌড়ে ভেতরে এলে তিনি আবার হাত ঘুরিয়ে পায়েস, ফুল ও মিছরি তাদেরও দিলেন। সত্যকে এমন আনন্দে উদ্ভাসিত দেখাচ্ছিল যে কেউ একজন শ্রী ভেংকাপ্পা রাজুকে খবর পাঠালেন সেখানে এসে সত্যের ভিতরকার পরিবর্তন দেখবার জন্যে। শ্রী ভেংকাপ্পা রাজুকে লোকের ভীড়ের ভিতর দিয়ে কোন প্রকার ঠেলে এগিয়ে যেতে হয়েছিল। লোকেরা তাকে হাত, পা, মুখ ধুয়ে তারপর বরদাতার কাছে যেতে বলেছিল! এতে সত্যের পিতা রেগে গিয়েছিলেন, তিনি দ্বিধা ও সন্দেহে পূর্ণ ছিলেন। রাগ ও বিহ্বলতায় তিনি একটি লাঠি তুলে নিয়ে সত্যকে ভয় দেখিয়ে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি ভগবান, কিংবা ভূত, অথবা এক পাগল? আমায় বল!” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসেছিল, “আমি সাই বাবা!” পিতা হতবাক হয়ে গেলেন, তাঁর হাত হতে লাঠি পড়ে গেল। সত্য আবার বলেছিলেন, “আমি আপস্তম্ব সূত্র’ সম্ভূত এবং ভরদ্বাজ গোত্রভুক্ত। (এই একই কথা শিরভি সাই বাবা বলতেন) তোমাদের সকল দুঃখ-কষ্ট তাড়াতে আমি এসেছি, তোমাদের গৃহ এবং মনকে শুদ্ধ ও নির্মল রাখবে।”
দাদা শেষমা রাজু কাছেই ছিলেন এবং তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “সাই বাবা বলতে কি বোঝাচ্ছে?” সত্য শুধু বললেন, “তোমাদের ভেংকাবধূত প্রার্থনা জানিয়েছিলেন, আমি যেন তোমাদের বংশে জন্ম নিই, তাই আমি এসেছি।” “তোমাকে নিয়ে আমরা কি করব?” বাবা জিজ্ঞেস করলেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এসেছিল, “প্রতি বৃহস্পতিবার আমায় পূজো করবে।”
‘সাইবাবা’ কথাটির অর্থ হল, দিব্য মাতা ও পিতা। ‘মাতা’ হলেন নিঃস্বার্থ প্রেমের প্রতীক এবং ‘পিতা’ হলেন জ্ঞান ও নিয়মানুবর্তিতার প্রতীক। ভগবান প্রেম এবং নিয়ম উভয় দিকেই ব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত করেন।
পরে এক বৃহস্পতিবার একজন কেউ সত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, তুমি যদি সাইবাবা হয়ে থাক তাহলে আমাদের একটা কিছু প্রমাণ দাও।” “আচ্ছা, আমি প্রমাণ দেব। কিছু জুঁই ফল আমার হাতে দাও।” সত্য আদেশ দিলেন। ঐ ফুলগুলো নিয়ে তিনি মেঝের উপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “দেখ!” ফুলগুলো দিয়ে আপনা থেকেই তেলেগু অক্ষরে লেখা হয়ে গেল “সাই বাবা”।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শিরড়ি ত্যাগ করার সময় বাবা দাসগানুকে তাঁর শেষ ইচ্ছা বলে বলেছিলেন তাঁকে ফুল দিয়ে ঢেকে দিতে এবং পুট্টাপর্তীতে তাঁর ঘোষণার পর তার প্রথম অনুরোধ ছিল তার হাতে ফুল তুলে দিতে। শেষমা রাজু এরপরেও সত্যের ঈশ্বরত্বকে চিনতে না পেরে তাঁকে আবার হাই স্কুলে পাঠানোর পরিকল্পনা করে রেখে তাঁকে উড়ভকাণ্ডায় নিয়ে গেলেন, যেখানে সত্যের যশকীর্তি তার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল।
উড়াভকোণ্ডার বৃহস্পতিবার গুলো এক বিরাট দিন হয়ে উঠল, শিরডির সাইবাবার ছবি সৃষ্টি করে, শিরডি বাবার কৌপীনের কমলা রঙের কাপড়, শিরডি পূজোর বেদীতে নিবেদিত খেজুর, ফুল, মিছরি ও বিভূতি এনে বাবা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন।
হসপেট শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ভিতর কয়েকজন তাদের শহরে যাবার জন্য সত্যকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রাচীন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাষ্পীর ধ্বংসাবশেষ হতে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক শহর হসপেট দেখতে শেষমা রাজু আগ্রহী হলেন। তিনি ভাবলেন যে, দীর্ঘ পথ ভ্রমণ এবং যাবার পথে বনভোজন ‘সত্যের জন্য ভাল একটি পরিবর্তন’ হবে! এই যাত্রার জন্য অক্টোবরের দশেরার ছুটিগুলো হাতের কাছেই পাওয়া গেল।
দলটি হাম্পির ধ্বংসাবশেষ দেখতে এল এবং এই যাত্রার উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল তাঁদের বিরূপাক্ষ মন্দিরে যাওয়া। দলের সবাই মন্দিরের ভিতর ঢুকলেও মন্দিরের গেটের উচ্চতা এবং মহিমময় কারুকার্য সম্পর্কে সত্য বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি বাইরেই রয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর পুরোহিত কর্পূর দিয়ে লিঙ্গের আরতি আরম্ভ করলেন। কর্পুরের শিখা পূজোর বেদীকে উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত করলে সকলেই আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেল যে লিঙ্গের জায়গায় সত্য দাঁড়িয়ে আছেন। সত্য মৃদু হাসছিলেন এবং আরতি গ্রহণ করছিলেন। শেষমা তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে এসে সত্যকে একটি দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলেন।
সেদিন যদিও বৃহস্পতিবার ছিল না, কিন্তু ঐ দলের লোকেরা সত্যকে বিশেষ পূজো করেছিল। দিব্য প্রকাশরূপে সত্যের উপর তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল।
পরদিন ঐ দলটি হসপেটে পৌঁছুল। হাম্পি শহরে যে অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল তার কাহিনী ইতিমধ্যেই হসপেট শহরে পৌঁছে গিয়েছিল। সেদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার এবং সত্যকে দর্শন করবার জন্য এক বিশাল জনতা সমবেত হয়েছিল। দীর্ঘকালের এক যক্ষারোগীকে শুধু স্পর্শ করেই তিনি ভাল করে দিয়েছিলেন এবং ভক্তদের জন্য নানা প্রকার জিনিষ সৃষ্টি করে বিতরণ করেছিলেন। লোকেদের আনন্দের আর সীমা ছিল না এবং তারা গভীর রাত্রি পর্যন্ত ভজন গেয়েছিলেন। পরদিন তারা সবাই উড়ভকোণ্ডায় ফিরে এসেছিলেন।