ময়ূরধ্বজের ভক্তি, অর্জুনের দর্পচূর্ণ
প্রাচীনকালে রাজারা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতেন। এই যজ্ঞে প্রথমে একটি ঘোড়াকে ছেড়ে দেওয়া হত। ঘোড়াটি দেশের পর দেশ ঘুরে বেড়াত। কেউ ঘোড়াটিকে বেঁধে ফেললে, তার সঙ্গে রাজার সৈন্যদের যুদ্ধ হত। যে ঘোড়াটিকে আটকাবে তাকে পরাজিত করে আবার ঘোড়াটিকে ছেড়ে দেওয়া হত। যে পক্ষ পরাজিত হত, তার সমস্ত রাজত্ব অন্য পক্ষের দখলে চলে যেত। এইভাবে ঘোড়াটিকে সারা দেশ ঘুরিয়ে এনে সমস্ত দেশ জয় করে অশ্বমেধ যজ্ঞে ঘোড়াটিকে বলি দেওয়া হত।
একবার পাণ্ডবরা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করে ঘোড়াটি ছেড়ে দিল। রাজা ময়ুরধ্বজ ঘোড়াটিকে বেঁধে ফেললেন। কৃষ্ণ আর অর্জুন ঘোড়াটিকে তার রাজত্বে দেখতে পেলেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে জানালেন যে ময়ুরধ্বজও তার একান্ত ভক্ত এবং তার সঙ্গে যুদ্ধে জয় লাভ করাটা সহজ হবে না। কিন্তু অর্জুন কৃষ্ণের কাছে মিনতি জানালেন যে যুদ্ধ ছাড়া ত’ আর উপায় নেই। কৃষ্ণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন যুদ্ধ আরম্ভ করল। কিছুতেই ময়ুরধ্বজকে কাবু করতে পারলেন না। তার গাণ্ডীব পর্য্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। ময়ুরধ্বজ কৃষ্ণভক্ত হলেও তারও যুদ্ধ ছাড়া গতি ছিল না। তাই তিনি কৃষ্ণের নাম নিয়ে প্রতিটি তীর অর্জুন আর কৃষ্ণের দিকে ছুঁড়ছিলেন। বাণগুলো এত তীক্ষ্ণ ছিল এবং জোরে আসছিল যে, কৃষ্ণ নিজেই দৌড়াদৌড়ি.
জানালেন যে ময়ূরধ্বজের মত কৃষ্ণ ভক্তের বিরুদ্ধে চক্র কাজ করবে না। অর্জুন ভাবলেন যে কৃষ্ণ তার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন। কারণ কৃষ্ণভক্ত হলে কি করে কৃষ্ণের প্রতি তীর ছুঁড়ছেন? কৃষ্ণও ময়ুরধ্বজের ভক্তির গভীরতা দেখাবার। জন্য অর্জুনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার দুইজন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ময়ুরধ্বজের রাজসভায় উপস্থিত হলেন। দুজন ব্রাহ্মণকে আসতে দেখে ময়ূরধ্বজ সিংহাসন। হতে উঠে নিজের মুকুট খুলে সাধারণ বেশে তাদের পা ধুয়ে প্রণাম করে অভ্যর্থনা জানালেন। ময়ুরধ্বজের ভক্তির গভীরতা দেখাবার জন্যে কৃষ্ণ একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ময়ূরধ্বজকে বললেন, “আমার ছেলেকে বাঘে ধরেছে। আমাদের মিনতিতে বাঘ ছেলেকে ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছে যদি রাজা ময়ূরধ্বজের শরীরের ডানদিকটি কেটে নিয়ে দেওয়া হয়। তাই আপনার কাছে এসেছি, যদি আপনি আমার একমাত্র ছেলের প্রাণ রক্ষা করেন।” এতে ময়ুরধ্বজ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “ব্রাহ্মণের প্রাণ বাঁচাতে আমার শরীরের প্রয়োজনের চেয়ে আনন্দের ও সৌভাগ্যের কি হতে পারে?” রাজা ময়ূরধ্বজ জানতেন যে কেবলমাত্র ত্যাগের ভিতর দিয়েই অমরত্ব লাভ হয়। তিনি এও জানতেন যে কেবলমাত্র অপরের কল্যাণ করবার জন্যে মানবদেহ দেওয়া হয়েছে। এই শরীর একদিন না একদিন নষ্ট হবেই। যদি একজনের উপকারে এই দেহ উৎসর্গ করা হয় তাহলে এর চেয়ে বড় কাজ আর কিছু হতে পারে না। তাই তিনি নিজের স্ত্রী ও পুত্রকে তরবারি দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেটে আদ্ধেক করতে বললেন।
তারাও ব্রাহ্মণের কল্যাণে স্বামী বা পিতার দেহ উৎসর্গীকৃত হচ্ছে জেনে শোক না করে তরবারি দিয়ে দেহ কাটতে উদ্যত হল। এই সময় ময়ূরধ্বজের বাঁ দিকের চোখ দিয়ে জল বেরোল। কৃষ্ণ তার স্ত্রী ও পুত্রকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আনন্দের সঙ্গে দান না হলে তা গ্রহণ করা ব্রাহ্মণের পক্ষে অনুচিত হবে। আপনার বাঁ দিকের চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তাই আমি এই দান নিতে পারব না। উত্তরে ময়ুরধ্বজ জানালেন, “আমি আনন্দের সঙ্গেই দেহ দান করছি। আমার বাঁ দিকের চোখ দিয়ে জল পড়ছে কারণ, বাঁদিকের দেহ কোন সৎকাজে লাগবে না, এমনি ফেলে দেওয়া হবে। কিন্তু ডান দিকের দেহ সৎকাজে ব্যয় হবে বলে ডান দিকের চোখ দিয়ে জল পড়ছে না। আর বাঁদিকের চোখ এই জন্যেই দুঃখ প্রকাশ করছে।” একথা শুনে অর্জুনের মনে হল যে ময়ূরধ্বজ তার চেয়ে অনেক বড় ভক্ত। অর্জুনের মনে একথা রণ করে ময়ূরধ্বজকে আশীর্বাদ করে বললেন, তার ভক্তির পরীক্ষা নেবার জন্যেই তারা এসেছিলেন। ময়ূরধ্বজ কৃষ্ণকে নিজের প্রাসাদে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন। কৃষ্ণের আরাধনা করে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় অর্জুন ও কৃষ্ণের প্রতি আতিথেয়তা দেখিয়ে তিনি ঘোড়া ছেড়ে দিলেন। এভাবেই জগতের কাছে ময়ূরধ্বজ এক আদর্শ রাজা ও ভক্ত হিসেবে স্থান করে নিলেন। ভক্ত হিসেবে তিনি নিজের শরীর পর্যন্ত দান করতে প্রস্তুত ছিলেন। রাজা হিসেবে, রাজার কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তিনি নিজের প্রভু ভগবানের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছিলেন। এ ভাবেই তিনি বিভিন্ন স্তরে নিজের দায়িত্ব পালন করে জগতের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন।