হারানো প্রাপ্তি
‘ফাদার লেভি’ খুব তৃপ্তভাবে তার বিস্তৃত চাষের জায়গাটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি খুব তৃপ্ত, কারণ তাঁর জমিতে খুব ভাল চাষ হচ্ছে। তাঁর পশুপালন খুব লাভজনক ভাবে হচ্ছে। তাঁর দুই ছেলে। তিনি আশা রাখেন খুব শিগগির দুই ছেলের বিয়ে দেবেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাতি নাতনির মুখ দেখবেন।
ফাদার লেভির জীবনে আনন্দ যেন উছলে পড়ছিল। কিন্তু হায়, এই আনন্দ বেশীদিন থাকল না। ফাদার লেভির ছোট ছেলে সীমন, তাকে ঐ দূরের শহর কেবলই হাতছানি দিয়ে ডাকত। সীমনের কেবলই মনে হতো শহরে কত আনন্দ, কত আলো, কত গান, কত নাচ আর সে এই গ্রামে বসে চাষের জমি দেখছে, শুয়োরের খাবার তৈরী করছে, গরু চালাচ্ছে, ভেড়া পালন করছে। তার প্রাণ আকুলি বিকুলি করতো ঐ শহরের আনন্দ উৎসবে যোগ দেবার জন্য।
একদিন ঐ শহরের ডাক সীমনের কাছে খুব জোর হয়ে উঠল। সে তখন সোজাসুজি গিয়ে তার বাবাকে বলল, “বাবা তোমার সম্পত্তিতে তো আমারও একটা অংশ আছে। তোমার জীবিত অবস্থাতেই আমাকে সম্পত্তির অংশটা দেবে বলেছিলে তা আমাকে দিয়ে দাও ; কারণ আমি আর এই গ্রামে থেকে নিজেকে নষ্ট করতে রাজি নই। আমি শহরে যেতে চাই, শহরের জীবনটা বড় ভালবাসি।”
ফাদার লেভির হৃদয় ভারাক্রান্ত হল। তিনি বুঝলেন যে ছেলে ভুল পথে যাচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তব জ্ঞান ছিল। তিনি জানতেন যে একে এখন ফেরাতে পারব না, তাই তিনি সীমনের কথায় রাজি হলেন। তার সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ ভাগ করে বিক্রি করে দিলেন এবং বিক্রির সমস্ত টাকা সীমনের হাতে তুলে দিলেন। সীমন খুব অধীর ব্যাকুলতায় এই টাকা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তক্ষুণি শহরের দিকে যাত্রা শুরু করল।
ফাদার লেভি ব্যথিত হৃদয় নিয়ে আকুলভাবে এই ছেলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন, হয়তো আর জীবিত অবস্থায় এই ছেলের মুখও দেখতে পাবেন না। তিনি জানতেন ছেলে ভুল করছে, ছেলে দুঃখের পথে যাচ্ছে কিন্তু অসহায় পিতার ছেলের সেই দুঃখ নিবারণ করবার কোন ক্ষমতা ছিল না।
সীমন শহরে গেল, তার পকেটে তখন কাঁচা পয়সা। তার বন্ধু-বান্ধবেরও অভাব হল না। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আনন্দ উৎসব বিলাসে শীঘ্রই সে মত্ত হয়ে উঠল। সে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে শহরের নাচ, গান বাজনায় জীবন কাটাতে লাগল। সীমনের টাকা পয়সা খরচ হয়ে কমে আসছিল, কিন্তু এর জন্য তার বিন্দুমাত্র চিন্তা বা দূরভাবনা ছিল না। সে নিশ্চিতভাবে জানতো ; এখন আমি বন্ধুদের জন্য টাকা খরচ করছি যখন আমার টাকা ফুরিয়ে যাবে তখন আমার বন্ধুরাই আমার জন্য টাকা খরচ করবে।
সেই দিনটা একদিন এলো যেদিন সীমনের টাকা ফুরিয়ে গেল। সীমন নিশ্চিন্তভাবে তার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বলল, ভাই আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে এবার থেকে তোমরা খরচ করবে এবং অত্যন্ত অবাক বিস্ময়ে ব্যথিত হৃদয় সে দেখল, একের পর এক বন্ধু তাকে অস্বীকার করল। তারা কেউই তাকে চিনতে রাজি হল না।
বন্ধুদের কাছ থেকে ফিরে সীমন চেনা শোনা লোকের কাছে গেল। তারা কেউ তাকে পাত্তা দিল না। সেই বিশাল শহরে অগণিত লোক কিন্তু সীমন আবিষ্কার করল, এই অগণিত লোকের মধ্যে একজন লোকও নেই যে তার দুঃখ বুঝতে চায়, যার কাছে সে মনের কথা বলতে পারে, পেটের খিদেটা মেটাতে পারে।
সীমনের তখন শহরের জীবন সম্বন্ধে মোহ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। সীমন্ ফিরল গ্রামের দিকে, মনে মনে ভাবল আর কিছু না জানি চাষের কাজ ত’ জানি যেকোনো ক্ষেতে গিয়ে কাজ করব, রোজগার করব, খাব।
কিন্তু হায়, সেখানেও তার জন্য কোন কাজ নেই। তার জামা-কাপড় শতছিন্ন, খেতে না পেয়ে তার শরীর শুকিয়ে গেছে, দুর্বল চেহারা, কেউই তাকে কাজ দিতে রাজি নয়। সে অবসন্ন দেহটাকে টেনে নিয়ে একজন থেকে আর একজন কৃষকের বাড়ীতে যেতে লাগলো। কিন্তু কেউই তাকে কাজ দিতে রাজি নয়। শেষ পর্যন্ত একজন সীমনকে দেখে বোধ হয় একটু মায়া হল। সে বলল, “হ্যাঁ সীমন্, তোমায় আমি কাজ দিতে পারি, আমার এই শুয়োরগুলোকে দেখবে।” এই শুয়োরের কাজ দেখা চাষী মজুরদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নীচু কাজ। সীমনের চোখ ফেটে জ্বল এল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পেটে খিদে তাই তাকে ঐ কাজটাই আকুলভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য করল। যখন এই শুয়োরগুলোকে খাবার দিত তখন সীমনের মনে হতো, শুয়োরের বদলে ঐ খাবারগুলো খেয়ে নিই, কারণ তখন তার অনেক দিনের খিদের জ্বালায় পেট জ্বলছে।
কিছু দিনের মধ্যেই সীমন্ এই বাস্তবের রূঢ় আঘাত পেয়ে বুঝতে পারল, কি ভুল সে করেছিল। সে বুঝতে পারল যে তার ভুলটা পাপের পর্যায়ে পড়ে এবং মনে মনে ঠিক করল আমি আমার বাবার কাছে ফিরে যাবো, বাবার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো, বলবো বাবা আমি অন্যায় করেছি, আমি ভুল করেছি, তোমার কাছে যে ক্ষমা চাইবো এমন মুখও আমার নেই। আমি বলব না, যে তুমি আমায় ছেলে হিসেবে ফিরিয়ে নাও। ছেলের দাবি তো তোমার কাছ থেকে সম্পত্তি নিয়ে আমি সেই দিনই মিটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাবা দয়া কর, আমাকে তোমার ক্ষেতের একজন মজুর হিসাবে নাও। তোমার মজুররাও আজকে আমি যেভাবে আছি তার চেয়ে ভাল ভাবে থাকে।”
এইসব কথা ভেবে সীমন্ তার অনাহার দুর্বল শরীরটাকে টানতে টানতে কোন রকমে অনেক দুরের পথ অতিক্রম করে নিজের বাবার বাড়ীতে ফিরে আসছে : মনে মনে ভাবছে আমাকে, সেদিনের সীমন্কে তো আর কেউ চিনতে পারবে না। আমার বাবাও হয়তো আমায় চিনতে পারবেন না। কিন্তু সীমন্ আর একবার ভুল করল। বাবা ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। সেই বৃদ্ধ পিতা তার আকুল চোখ মেলে রাখতেন তার ফেরার পথ চেয়ে। কাজেই সীমন্ যখন ফিরছে দূর থেকেই সেই শতচ্ছিন্ন পোষাক পরা ভিখারীর বেশে ছেলেকে দেখে তার হৃদয় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠল। তিনি হাততালি দিয়ে লোকজনকে ডাকলেন এবং তাদের বললেন, আমার ছেলে ফিরে আসছে, তোমরা শীঘ্র তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তারা গিয়ে অভর্থনা করে ছেলেকে নিয়ে এলো। সীমন্ এসেই বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল “বাবা, আমি পাপ করেছি, আমি তোমায় অশ্রদ্ধা করেছি, আমি তোমার প্রতি অকৃতজ্ঞতা করেছি, ভগবান আমায় ক্ষমা করবেন না। আমি তোমার কাছেও ক্ষমা চাইব না। বাবা তুমি আমাকে তোমার চাকর হিসাবে রেখে দাও।”
ফাদার লেভি বললেন, “কি আবোল-তাবোল বলছ।” বলেই আবার তিনি হাততালি দিয়ে লোকজন ডাকলেন। তারা এলে তাদের বললেন “যাও, আমার সবচেয়ে ভাল পোষাকটা নিয়ে এস, সীমন্ সেটা পরবে, সঙ্গে আংটিটা আনতে ভুলো না।—ঐ আংটি পরে সে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে যে সে আমারই ছেলে, আর সে বেচারী খালি পায়ে ঘুরে পা গুলোকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে, কাজেই খুব ভালো একজোড়া চটি বেছে নিয়ে এসো, যাতে সে সেটা পরতে পারে। আজ রাত্রি বেলায় এখানে পার্টি হবে, আনন্দ উৎসব হবে, তার ব্যবস্থা ক’রো। উৎকৃষ্ট পানাহারের ব্যবস্থা ক’রো।।”
কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল, হাসি, গান আনন্দ কোলাহলে। এই আনন্দ কোলাহল অনেক দূর অবধি শোনা যেতে লাগল এবং অনেক দূর থেকে এই আনন্দ কোলাহল একজন শুনতেও পেল। এ হচ্ছে জুড্।,জুড্ ফাদার লেভির বড় ছেলে। সে কিন্তু এতদিন বাবার চাষের ক্ষেতে প্রাণপণে কাজ করত, সারাদিন ধরে কাজ করত, নিষ্ঠাভরে কাজ করত এবং বাবাকে যাতে খুশী রাখা যায় সেই চেষ্টায় থাকত।
সে চাষের কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরছে দূর থেকে দেখতে পেলো, বাড়িতে আলোর রোশনাই, গানের সুর। ভাবল, কি এমন হয়েছে, যে বাড়ীতে এত আনন্দের জোয়ার জেগে উঠেছে?
একটু পরে ছুটতে ছুটতে এসে তার বাড়ীর লোক খবর দিল যে তাড়াতাড়ি বাড়ী চলুন। বাড়ীতে ছোটকর্তা (সীমন) ফিরে এসেছেন এবং ফাদার লেভি সেই জন্য বাড়ীতে আনন্দ উৎসবের নির্দেশ দিয়েছেন। এই কথা শুনে জুডের মনটা কিন্তু বিষিয়ে গেল। সে ভাবল যে আমি এখানে সারাদিন ধরে মাঠে রোদে, জলে কষ্ট করলাম, ক’ই আমার জন্য তো কোনদিন বাবা পার্টি দেননি। আমার জন্য তো কোনদিন উচ্ছৃঙ্খল আনন্দ উৎসব হয়নি। আর এই হতভাগা ছেলে, সে বাবার সম্পত্তি বিক্রীর টাকা নিয়ে গিয়ে শহরে গিয়ে স্ফূর্ত্তি করে সেটাকে উড়িয়ে দিয়ে এল, তার জন্য বাবা পার্টি দিচ্ছেন। তার মনটা বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেল। সে চুপচাপ তার নিজের ঘরে গিয়ে বসে রইল।
ফাদার লেভি লোক পাঠালেন জুড্কে ডাকবার জন্যে। তাকে জুড্ বলল, “তুমি বাবাকে গিয়ে বল, তাঁর যে অকৃতজ্ঞ সন্তান, বাবার এই কষ্ট করে উপার্জন করা সম্পত্তি বিক্রীর টাকা শহরে নিয়ে গিয়ে স্ফূর্ত্তি করে উড়িয়ে দেয়, তার আনন্দ উৎসবে যোগ দেওয়া আমার বিন্দুমাত্র কোন আগ্রহ নাই।”
ফাদার লেভি এই কথা শুনে নিজে স্বয়ং ছেলেকে ডাকতে এলেন। ডাকতে আসাতে জুডের ভেতরে জমে থাকা, সমস্ত ক্ষোভ তার কথায় ঝরে পড়ল। এই কথায় ফাদার লেভি কিন্তু এতটুকু বিচলিত হলেন না। তিনি বাবা হিসেবে দুই সন্তানকেই সমান ভালবাসতেন। তিনি দুহাতে জুডকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যে “বাবা, রাগ কোরো না, রাগ কোরো না। আমি সীমনকে ঠিক ততটাই ভালবাসি যতটা তোমায় ভালবাসি।” জুড বলল, “তাহলে এই কি ন্যায়বিচার হল, যে সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে এল, তার জন্য আজকে তুমি উৎসব করছ?” বাবা বললেন, যে “প্রিয় পুত্র, তুমি উত্তেজিত হ’য়ো না। তুমি শুধু একবার ভেবে দেখ, আমি ভেবেছিলাম বৃদ্ধ বয়সে আমি আমার এক সন্তানকে হারালাম। আমি ভাবিনি তার সঙ্গে আর দেখা হবে, আসলে সে আমার কাছে মৃত হয়ে গিয়েছিল। আজ সীমন্ ফিরে আসায় মনে হচ্ছে আমার সেই মরে যাওয়া ছেলে যেন ফিরে এলো। আর কেউ যদি মরে যাওয়ার পর বেঁচে ওঠে তবে তো আনন্দ উৎসবই হয়। আমি সেই আনন্দই করছি, মরে যাওয়া ছেলেকে আবার জীবিত ফিরে পেলাম, সেই আনন্দই করছি। তুমিও যদি একটু শান্ত হয়ে ভাব, তোমারও সেই আনন্দই হবে। সে ভুল করেছে তা বলে আমরা ভুল করতে পারি না।”
প্রশ্নঃ
- ফাদার লেভির দ্বিতীয় পুত্রের চরিত্র কেমন ছিল?
- ছোট ছেলে সম্পত্তির ভাগ চাইলে ফাদার লেভি কি করলেন?
- ফাদার লেভি কবে তার হারানো ছেলেকে খুঁজে পেলেন?
- তার বড় ছেলে কেন রেগে গেল? ফাদার তাকে কি উত্তর দিলেন?