সংশ্লিষ্ট গল্প
ভগবানের নাম বিষকেও অমৃতে পরিবর্তন করে। মীরা নিরন্তর কৃষ্ণের নাম জপ করতেন। তাঁর এই অবস্থা ও জীবনযাপনের ধারা দেখে মহারাণা মীরার স্বামী, সকল রকম প্রচেষ্টা করেন কৃষ্ণ নামের প্রতি মীরার পাগলামি দূর করতে। মীরার কোন রকম ভেদাভেদ ছিল না। সে যেখানে সেখানে কৃষ্ণ নাম গাইতে গাইতে চলে যেতেন, এমন কি রাজাদের দরবারে, রাস্তায় সাধুসন্তদের কাছে, এমন কি সাধারণ প্রজাদের মধ্যেও। মহারাণা এগুলি দেখতেন। উনি ভাবতেন “আমি একজন রাজা। আমার রাণী ভিখারীর মত তানপুরা বাজিয়ে সাধারণ প্রজা, সাধুসন্ত, অন্য রাজ্যের রাজাদের কাছে চলে যান কোন দ্বিধা না করে।“ উনি অপ্রস্তুত বোধ করতেন। উনি বহুবার মীরাকে বলেছেন, “কৃষ্ণ নাম গান অমর্যাদার নয়। গুণ কীর্তন করা সৌভাগ্য। তুমি যদি ঈশ্বরের নাম গান না করো সেটা অপমান জনক। কিন্তু তুমি যদি অন্যের তোমার ওপর প্রতিক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি না দাও, তাহলে তুমি তোমার আত্ম চেতনা হারাবে। তুমি ঈশ্বরের নাম গান করবে ভালবেসে, নিজের স্বার্থে আর সাহসের সাথে নামকীর্তন কে তোমার কর্তব্য ও অধিকার হিসেবে।”
কিন্তু মীরা তাঁর মতে অটল থাকেন আর তাঁর অবস্থান সে কখনও পরিবর্তন করেন নি। বহুভাবে মহারাণা তাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। উনি মীরাকে বলেছিলেন, “মীরা, তুমি যদি এইভাবে ভজন গাইতে থাকো, জগৎ তোমাকে পাগল ভাববে। তোমরা আসেপাশের মানুষ তোমার সম্পর্কে রটনা করবে। “এর উত্তরে মীরা বলেন, “মহারাণা, কাক চিৎকার করে বলে কি কোকিল তার গান থামায়? ঈশ্বরের নামগান ওই কোকিলের গানের মতো। শুধুমাত্র কুকুর তারাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে বলে কি তারা পৃথিবীর বুকে খসে পড়ে? তাহলে কেন একজন যার মুখে নিরন্তর ঈশ্বরের নাম, এমন একজনের কাছে নতি স্বীকার করবে যে সর্বদা নীচ কাজে লিপ্ত থাকে? “মহারাণা মীরার তর্ক শুনে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হন। রাজার স্বভাব ই রাজসিক। ভক্তের মধ্যে সত্ত্ব গুণ মূর্ত। এই দুই স্বভাবের মধ্যে কোন সমতা বা সাদৃশ্য থাকতে পারে না। জল আর অগ্নি যেমন একসঙ্গে থাকতে পারে না। মীরার স্বভাব রসালো খেজুরের মতো মিষ্টি, আর মহারাণার স্বভাব তেঁতুলের মতো। একবার খেজুরের স্বাদ পেলে কেউ তেঁতুল খেতে চায় না। আবার যে তেঁতুল খেতে ভালবাসে সে খেজুরের স্বাদ পছন্দ করে না। যার আহারে রুচি ভালো সে বদহজমে কষ্ট পায় না। যে ঈশ্বর কে ভালোবাসে আর তাঁর জন্য সকল প্রকার কষ্ট সহ্য করে সে, সেই লোকটির মত যার ক্ষুধা কখনও তৃপ্ত হয় না। এই দুইয়ের মধ্যে কখনও সঙ্গতি থাকতে পারে না। মীরা ও মহারাণা ঠিক সেরকমই। মহারাণা বুঝতে পারলেন যে মীরার স্বভাব পরিবর্তন করা সম্ভব না, এবং যতদিন মীরা বেঁচে থাকবেন তাকে এই অপমান সহ্য করতে হবে। তাই তিনি ঠিক করলেন মীরাকে হত্যা করবেন। বোনের সাথে পরামর্শ করে মীরার দুধে বিষ মিশিয়ে দেন। মীরা সবসময় কৃষ্ণ কে নিবেদন করে খেতেন।
বিষ আছে না জেনে তিনি কৃষ্ণকে দুধ নিবেদন করেন, মূর্তিটি নীল হয়ে যায় আর মীরার দুধ বিষমুক্ত হয়। সেই সময় মহারাণা ঘরে আসেন এবং চিৎকার করে বলেন, “তুমি এখানে থাকতে পারবে না। আমি রাজা আর তুমি আমার নাম কলঙ্কিত করছ? এই প্রাসাদ আমি নির্মাণ করেছি। তুমি আমার নির্মিত প্রাসাদে থাকতে পারবে না। “মীরা দুঃখিত হন এবং কৃষ্ণ মূর্তির রঙ পরিবর্তনের কারণ ভাবতে থাকেন।। মীরা সাহস করে মহারাণাকে বলেন” এটা সত্য যে আপনি এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন, এতে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু আমার হৃদয়ের মধ্যে যে কৃষ্ণের মন্দির আছে সে তো আপনার সৃষ্ট নয়। সেটি কৃষ্ণ দ্বারা নির্মিত। উঁনি আমার ভেতরে আছেন। কারো অধিকার নেই কৃষ্ণ কে বলার যে তিনি আমার সাথে থাকতে পারবেন না। “মীরা বলেন, “হে মন! কেন তোমার এত মায়া? এই মায়ার জন্যই তো দুঃখ কষ্ট ভোগ।” এই বলে সে গান ধরে, সেই গানে বলা হয় মন তুমি প্রয়াগে চলো, যেখানে গঙ্গা ও যমুনা মিশেছে (চলো রে মন গঙ্গা যমুনা তীর)।
এখানে মীরা ভৌগলিক অবস্থানের কথা বলেননি। মীরা বলতে চেয়েছেন, ওঁর হৃদয়ের যেখানে গঙ্গা যমুনা একত্রিত হয়েছে, ওঁর দুই ভ্রুর মাঝখানে। ‘ইড়া’ নামক স্নায়ু হল গঙ্গা আর ‘পিঙ্গলা’ নামক স্নায়ু হল যমুনা। এই দুইয়ের মধ্যে যে স্নায়ু সেটি হল ‘সুষুম্না’, আর এটিই হল প্রয়াগ। মীরা ওঁর মনকে দুই ভ্রুর মাঝখানে স্থির করলেন। ওঁর মন ওখানেই স্থিত হল এবং সেই মুহুর্তে মীরা কৃষ্ণের সাথে মিলিত হলেন। মীরা এই পবিত্র অবস্থান শুধু মাত্র আকুল বিশ্বাস ও ঈশ্বরের নামস্মরনের জন্য প্রাপ্ত হন।।
[Illustrations by B.G.Sai Pratheem, Sri Sathya Sai Balvikas Student.]
[সূত্র : ভগবানের নাম গান কর, দিব্যবাণী ১৭,মাই ডিয়ার স্টুডেন্টস, ৪র্থ খন্ড]