মাতা কন্যাকুমারীর পদতলে- তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যের উদ্ঘাটন
কন্যাকুমারী ভ্রমণ বিবেকানন্দের জীবনে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অধ্যায়। মন্দিরে দেবী জননীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতের পর তিনি সমুদ্রে সাঁতরে একটি সাগরবেষ্টিত ছোটো পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ঐ পাহাড়টি প্রধান ভূখণ্ড থেকে আলাদা। ভারতের এই শেষ সীমারেখায় বসে তিনি মাতৃভূমির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ; মাতৃভূমির অধঃপতনের কারণ ও পুনরুত্থানের উপায় সম্বন্ধে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। তিনি নিজে এই ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন এভাবে:
কন্যাকুমারীতে ভারতের শেষ প্রস্তরখণ্ডের উপর মা কুমারীর মন্দিরে বসে আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এল। আমরা এতজন সন্ন্যাসী মিলে ঘুরে ঘুরে লোকদের যে দার্শনিক তত্ত্ব শিক্ষা দিচ্ছি, এর সবটাই পাগলামি; আমাদের গুরু কি বলেন নি- “খালি পেটে ধর্মাচরণ হয় না।” শুধু অজ্ঞানতার জন্যই দরিদ্র লোকেরা জন্তুর মতো জীবনযাপন করছে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে কয়েক- জন সন্ন্যাসী যাঁরা সকলের হিতসাধনের চেষ্টা করছেন, তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মৌখিক শিক্ষা এবং মানচিত্র, ক্যামেরা, ভূগোলক ও অন্যান্য উপযোগী উপকরণের মাধ্যমে সবাইকে, এমন-কি, চণ্ডালকেও শিক্ষা দেয়- তা হলে কি কোনো সময়েই ঐ সব লোকদের মঙ্গল হবে না? জাতি হিসেবে আমরাই আমাদের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করেছি এবং সেটাই ভারতবর্ষের দুঃখ দুর্দশার কারণ। আমরা আবার জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ফিরয়ে আনব এবং জনগণের উন্নতি করব।’
স্বামী বিবেকানন্দ এইভাবে কন্যাকুমারীতে ভারতবর্ষের সেবায়, বিশেষ করে ভারতের উপবাসী, উৎপীড়িত, সমাজচ্যুত জনগণের মঙ্গলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলেন; এই স্থানেই তিনি একজন দেশপ্রেমিক সন্ন্যাসীতে রূপান্তরিত হলেন- যাঁর প্রচারিত ধর্মে ভারতবাসীর উন্নয়ন ও হিত-সাধন করার ব্রত ছিল ধ্যান জপ, যোগাভ্যাস বা বেদ অধ্যয়নের মতোই প্রয়োজনীয় ও সমপর্যায়ভুক্ত। এই কন্যাকুমারীতেই তিনি অনুভব করেন তাঁর গুরুদেবের অন্তর্দৃষ্টি ও সেই ভবিষ্যৎবাণী- তাঁকে (বিবেকানন্দকে) জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে হবে। এই স্থানেই তাঁর মনে উদিত হয় আমেরিকায় যাওয়ার সঙ্কল্প, সেখান থেকে ভারতবর্ষে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল ও অন্যান্য জনহিতকর কার্যের জন্য অর্থসংগ্রহ করা এবং এইভাবেই দেশবাসীর দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্য সক্রিয় পরিকল্পনার সূচনা করা। এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপায়ণ হল- যখন রামনাদের রাজা প্রস্তাব করলেন যে বিবেকানন্দের উচিত হবে সদ্যঘোষিত শিকাগোর ধর্মীয় মহাসম্মেলনে যোগ দেওয়া। যখন তিনি মাদ্রাজ উপস্থিত হলেন, তখন সেখানে তাঁর অনুগামী কয়েকজন উৎসাহী যুবক অর্থসংগ্রহ করে তাঁকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য সম্মত করল। কিন্তু তিনি স্থিরনিশ্চয় ছিলেন না, যে এই কাজে তিনি মাতা সারদা দেবীর আশীর্বাদ পাবেন কিনা। ঠিক এই সংকট মুহূতে’ তিনি একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে তাঁর গুরুদেব এসেছেন এবং তাঁকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে চলেছেন। অনুরূপ ভাবে সারদা মা স্বপ্ন দেখলেন যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ উপস্থিত হয়ে সারদা মাকে বলছেন বিবেকানন্দকে আশীর্বাদ করে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিদেশ পাঠাতে।
ক্ষেত্রীর রাজা বিবেকানন্দকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর সমুদ্রযাত্রার সব আয়োজন করে দিলেন।