ভারত-দর্শন
মাতৃভুমিকে ভালোভাবে জানার ইচ্ছা এবং গুরুদেবের উপদেশবাণীকে সুষ্ঠুভাবে কি করে দেশের সর্বত্র প্রচার করা যাবে, সে সম্বন্ধে প্রকৃষ্ট জ্ঞান- লাভের উদ্দেশ্যে নরেন্দ্রনাথ ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক হলেন।
রামকৃষ্ণের মহাপ্রয়াণের পর সারদা দেবী তরুণ শিষ্যদের আধ্যাত্মিক নির্দেশিকা ছিলেন। ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে বিবেকানন্দ তাঁর কাজ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং পরিব্রাজকরুরূপে ভ্রমণে রত হন। অধিকাংশ সময়ে পদব্রজে প্রায় পাঁচ বৎসর ধরে তিনি ভারত ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণ- কালে তাঁকে অনেক দিন উপবাসী থাকতে হত এবং মরুভূমি ও অরণ্যের মধ্য দিয়েও চলতে হত, এবং সময়ে সময়ে জীবনও বিপন্ন হত; কিন্তু ক্লেশে ও বিপদে নির্ভীক হয়ে তিনি প্রকৃত সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন। কোনো- দিন হয়ত খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হত- আবার কোনোদিন হয়ত কোনো মহারাজা বা দেওয়ানের সম্মানিত অতিথি হতেন। এইভাবে কোনোদিন লক্ষ লক্ষ কুঁড়েঘরের অধিবাসীদের মালিন্যময় দুঃখগ্রস্ত জীবন- যাত্রা দেখতেন, পরদিন হয়তো বিরাট প্রাসাদে রাজকীয় বিলাসিতাকে প্রত্যক্ষ করতেন। তিনি এইভাবে জাতি, সম্প্রদায়, ভাষা, আচার-ব্যবহার বৈচিত্রোর মধ্যেও ভারতবর্ষে’র ঐক্য প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাঁর দেশবাসীর শক্তি ও দুর্বলতাকে প্রণিধান করে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন, বা তাঁকে অনেক সহায়তা করেছিল যখন তিনি বিশ্বের পটভূমিতে শিক্ষাদাতা ও সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য- যা তিনি পরি-ভ্রমণের সময় দেখেছিলেন সারা জীবন ধরে তাঁকে বেদনা দিয়েছে। ‘কেমন করে এদের সাহায্য করব? কেমন করে এদের সাহায্য করব? কেমন করে এদের সাহায্য করব?’- এই চিন্তাই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং জীবনের পরবর্তী’ বৎসরগুলিতে আধ্যাত্মিক প্রচার কার্যে’র সঙ্গে এই চেষ্টাই তাঁর কাছে প্রাধান্য লাভ করেছিল।
এই বিদেশ প্রবাস কালে তিনি তদানীন্তন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন; কয়েকজন রাজকুমার তাঁর বন্ধু ও শিষ্য হয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ক্ষেত্রীর মহারাজা অজিত সিং- যিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ভ্রমণশীল সন্ন্যাসী হিসাবে কাছাকাছি স্থানে যেতেন।
তাঁর আলওয়ার ভ্রমণের সঙ্গে জড়িত একটি কাহিনী ছোটো হলেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ’ ও সকলের কাছে এটি একটি উপদেশের মতো। তিনি মন্ত্রীদের দ্বারা রাজসভায় আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আলোয়ারের তরুণ মহারাজা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি ছিলেন আধুনিক ভাবাপন্ন ও নাস্তিক। তিনি বিদ্রূপচ্ছলে জিজ্ঞাসা করলেন ‘স্বামীজী! আপনি ভগবানের কথা বলেন- কিন্তু আপনি কি মন্দিরের পাথরের মূর্তিতে বিশ্বাস করেন?’ বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, ‘নিশ্চয়ই!’ মহারাজা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভগবান কী করে পাথরের তৈরি হতে পারেন?’ স্বামীজী মন্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ‘অনুগ্রহ করে মহারাজার ঐ ছবিটি দেওয়াল থেকে নামিয়ে আমায় দিন।’ মন্ত্রী তাই করলেন এবং তখন স্বামীজী তাঁকে বললেন, এখন এর উপর থুথু ফেলুন, কারণ এইটি তো মহারাজা নন।’ মন্ত্রী বললেন, ‘না, না, এ আমি কি করে করব?’ বিবেকানন্দ তখন মহারাজার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমি কি বলতে চাই তা এখন বুঝেছেন? পাথরও এই চিত্রের মতোই- একটি প্রতীক- ভগবানের পবিত্র প্রতীক- পরম সত্য।’
আবু পাহাড়ে একজন মুসলমানের গৃহে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ঐ মুসলমান তাঁকে খাদ্য গ্রহণ করার অনুরোধ জানাতে ইতঃস্তত করছিলেন, কারণ তিনি ভাবছিলেন যে একজন অহিন্দুর হাত থেকে তিনি খাদ্য গ্রহণ করবেন কিনা। বিবেকানন্দ তাঁর চিন্তাকে উপলব্ধি করে বললেন- ‘আমার কাছে সব জাত ও ধর্মবিশ্বাস একই, এবং সবাই আমার ভাই।’ তিনি পুনায় বিখ্যাত জাতীয় নেতা বালগঙ্গাধর তিলকের গৃহে অবস্থিতি করেন।
মহীশূরের মহারাজা তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শন করেন এবং তাঁকে পাশ্চাত্যদেশ ভ্রমণের জন্য আর্থিক সাহায্য করতে চান-যাতে তিনি সেখানকার অধিবাসীদের কাছে বেদান্তের সার্বজনীন নীতিবাদকে উপস্থাপিত করতে পারেন। মহীশূর থেকে তিনি ত্রিবান্দম ও কন্যা-কুমারী যান।