পথের সমাপ্তি
মঠে এসে স্বামীজি শুনলেন যে ২৮ অক্টোবর ক্যাপটেন সেভিয়ার পর- লোক যাত্রা করেছেন; তিনি তখনই মায়াবতীর উদ্দেশে যাত্রা করলেন মিসেস সেভিয়ারকে সান্তনা দেওয়ার জন্য। তিনি সেখানে এক পক্ষকাল ছিলেন। অদ্বৈতের নামে উৎসর্গিত হিমালয়ের এই আশ্রমের মনোরম দৃশ্যাবলী তাঁকে আনন্দ দিয়েছিল।
বেলুড়ে ফিরে সাত সপ্তাহ বাদে তিনি পূর্ব’বঙ্গ এবং আসামের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তাঁর জননী সেখানকার পবিত্র তীর্থ’গুলি দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনিও সঙ্গে যান। তিনি মিসেস বুলকে লিখলেন যে, এটি একজন হিন্দু বিধবার ‘একটি ঐকান্তিক ইচ্ছা। আমি আমার পরিবারের সকলকে খুবই দুঃখ দিয়েছি; সেইজন্য আমি আমার মাতার এই একটি ইচ্ছা পূর্ণ করার চেষ্টা করেছি’।
ফিরে এসে স্বামীজি মঠে শান্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করলেন। তিনি মঠের চারধারে ঘুরে বেড়াতেন, কখনো কখনো শুধু কটিবস্ত্র পরিধান করতেন, কখনো রান্নার তদারকি করতেন বা কখনো সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ভজন গান করতেন। যে কেউ তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক পরামর্শের জন্য এলে তিনি সর্বদাই তা দিতেন। কিন্তু ধরাবাঁধা সকল কর্ত’ব্য কর্ম’গুলি গুরুভাইদের হাতে ওকালতনামার মাধ্যমে অর্পণ করে নিজে মুক্ত হলেন, এমন-কি বেলুড় মঠের সব সম্পত্তি, যা এতদিন তাঁর নামে ছিল, তাও তিনি গুরুভাইদের হস্তান্তরিত করেন। যে-সব সাঁওতাল মজুররা মঠের কাজ করছিল তাদের একদিন ভোজন করালেন। তারা জীবনে এমন সুস্বাদ, খাদ্য বা এমন ভোজ খায় নি। তারা খুবই খুশি হল। স্বামীজি তাদের বললেন- ‘তোমরা নারায়ণ, ভগবানের স্বরুপ, আজ আমি নারায়ণকে খাদ্য উৎসর্গ করলাম।’ পরে তিনি ভক্তদের বললেন, ‘আমি এদের সাক্ষাৎ ঈশ্বররূপ বলে ভেবেছি- এই সরলতা, নিষ্পাপ আন্তরিক ভালোবাসা আমি আর কোথাও দেখি নি। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা হয় যে এই মঠ ও অন্যান্য সব জিনিস বিক্রি করে যা পাওয়া যাবে তা দরিদ্র ও নিঃস্বদের মধ্যে বিলিয়ে দিই।’
তাঁর জীবনের সূর্যাস্ত এগিয়ে আসছিল। ৪ জুলাই ১৯০২ সালে তিনি সকাল ৮টা থেকে ১১টা অবধি ধ্যানে মগ্ন রইলেন, কিন্তু সাধারণত তিনি তা করতেন না। বৈকালের দিকে ভ্রমণে গেলেন; সন্ধ্যার সময় কিরে নিজের ঘরে এক ঘণ্টা ধ্যান করলেন, তারপর তিনি শাস্ত হয়ে শুয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ বাদে দুইবার গভীর প্রশ্বাস নিয়ে চির-বিশ্রামে রত হলেন। সম্ভবত তাঁর আরব্ধ কার্যের পরিসমাপ্তি হওয়ায় গুরুদেব যেন তাঁকে অঙ্গীকৃত ‘চাবি’টি পরমাত্মার অনন্ত ঐশ্বর্য সন্ধানের জন্য ফিরিয়ে দিলেন।
লন্ডনে তিনি একবার বলেছিলেন- ‘এমনও হতে পারে যে আমার দেহের বাইরে যাওয়াই আমার শ্রেয় মনে হবে এবং এই দেহকে জীর্ণ’ বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু আমার কর্ম’ স্তব্ধ হবে না। আমি মানুষকে প্রেরণা দিয়ে যাব যতদিন না জগৎ উপলব্ধি করে যে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে এক।’ তিনি শুধু মরদেহই ত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাঁর অমর আত্মা জগৎকে আলোক বিকীরণ করায় রত আছে।
বিবেকানন্দ বলতেন, ‘অদ্বৈত চিরন্তন, সে নিশ্চয়ই থাকবে। প্রাত্যহিক জীবনে ছন্দায়িত হবে সে; যোগবিদ্যার অসহায় বিভ্রান্তি থেকে রূপ গ্রহণ করবে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাবহারিক মনোবিজ্ঞান, কিন্তু এসব কিছুকেই এত সহজ হতে হবে যে, একজন সরল শিশুও তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। এই আমার জীবনের কাজ। ঈশ্বর জানেন আমি কতদূর কতকার্য হতে পেরেছি।’
তিনি যে এ বিষয়ে বহুল পরিমাণে কৃতকার্য হয়েছিলেন, তা নিশ্চিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘যদি তুমি ভারতবর্ষ’কে জানতে চাও, তবে বিবেকানন্দকে অধ্যয়ন কর। তাঁর মধ্যে সবই ছিল প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ বলে কিছুই ছিল না।’ মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘আমি তাঁর সমস্ত রচনা খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি, এবং সেগুলি পড়ে দেশের জন্য আমার মনে যে ভালোবাসা ছিল তা সহস্র গুণ বেড়ে গিয়েছে।’