ভূমিকা
ভারতবর্ষে’র বৈদান্তিক ধর্মে’র যে দীপশিখা তদানীন্তন পাশ্চাত্য-সংস্কৃতির ঝোড়ো হাওয়ায় নির্বাপিতপ্রায় হয়েছিল, রামকৃষ্ণ তার তেল ও সলতে পুনরায় পূর্ণ করে তাকে প্রজ্জ্বলিত করেন। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার বস্তুতান্ত্রিক প্রগতির ঔজ্জ্বল্য ভারতীয় মনকে অভিভূত করে তুলছিল। আমাদের প্রচলিত রীতি নীতি ও বিশ্বাসসমূহ দেশের লোকের আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল এবং নৈতিক চরিত্রের মান খুবই নীচে নেমে গিয়েছিল। ভারত- বাসীদের বিশ্বাস করানো শুরু হয়েছিল যে, হিন্দুধর্ম’ কেবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অগভীর ও সারপদার্থ’হীন ধারণা-সমষ্টি। এই সঙ্কটমুহূর্তে শ্রীরামকঞ্চ আবির্ভূত হলেন এবং হিন্দুধর্মে’র কালিমালিপ্ত প্রদীপকে পরিমার্জিত করে, তার ক্ষীয়মান সলিতাকে উন্নত ও দৃঢ় করে পুনরায় তৈলনিষেকে সেই কম্পিত অধ্যাত্ম-দীপশিখাকে প্রজ্বলিত ও অকম্পিত করে তুলেছিলেন। সেই প্রদীপ্ত শিখাকে দক্ষিণেশ্বরের সীমা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশব্যাপী অন্ধকারকে দূরীভূত করার প্রয়োজন ছিল। এবং সমগ্র মানবজাতির মঙ্গলার্থে ঐ অধ্যাত্ম-শিখার রশ্মিতে অন্য দেশকেও আলোকিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল।
এই কঠিন কার্য’ সমাধার জন্য একজন প্রচুর কর্ম’শক্তিপূর্ণ ব্যক্তির প্রয়োজন হল। এই দায়িত্বভার সঠিক ভাবেই রামকৃষ্ণের প্রিয়শিষ্য নরেন্দ্রনাথের উপর পড়ল, পরে যিনি বিবেকানন্দ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। তিনি বেদাস্তের মূল সত্যগুলিকে রামকৃষ্ণের অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখা করে প্রচারে রত হন। তিনি দেশবাসীকে এই ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন যে, যদি রামকৃষ্ণের অপূর্ব আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য ও ধারণাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বেদান্ত পুনঃব্যাখ্যাত হয়ে আধুনিক জীবনের ভাবধারায় নিয়োজিত হয়, তবেই যে-সমস্যায় আজ ভারতবর্ষ’ জর্জ’রিত, তার সুরাহা সম্ভবপর। এই ভারত আবার মানবজাতিকে অধ্যাত্মবাণী শোনাতে পারবে। ইউরোপে ও আমেরিকায় বেদান্তের সত্যগুলি নিয়ে বক্তৃতা ও আলোচনার সময়ে তিনি ভারতবাসীর উদ্দেশ্যেও ঐ সব বৈদান্তিক সত্যগুলিকে প্রত্যক্ষ করার জন্য ঐকান্তিক অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এবং একথাও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে• বলেছিলেন যে, ধর্ম’ শুধু বিশ্বাসনির্ভর নয়, যে সত্যের উপর ধর্ম’ প্রতিষ্ঠিত তার বাস্তব অনুভবও একান্ত আবশ্যকীয়। ধর্ম’ বলতে সত্য অর্থাৎ ভগবানকে উপলব্ধির অভিজ্ঞতাকে বোঝায়।
বিবেকানন্দ সব সময়ে এই যুক্তির অবতারণা করতেন যে, বেদান্তের প্রকৃত ব্যাবহারিক রূপ হবে অনতিবিলম্বে মানুষের মানসিক উন্নয়ন ঘটানো এবং ক্লেশের লাঘব করা। এই হল বেদান্ত ও ধর্মে’র ব্যাবহারিক রূপ। বিবেকানন্দের মতানুসারে আদর্শ’ সমাজ হবে ভারতের অধ্যাত্ম-সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের ঐহিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার সংমিশ্রণ। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা করেছেন- যা হল আধ্যাত্মিক আদর্শ’ ও সেবাকার্যে’র একত্র সমাবেশ। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই মিশন অতুলনীয় ও সুচারু ভাবে মানব সেবাকার্য’ করে চলেছে। তিনি যেমন প্রচার করেছিলেন যে বেদান্ত হচ্ছে জীবনের উদার ও সর্বজনগ্রাহ্য দার্শনিক রূপ, তেমান সেই উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য অ-ভারতীয় দেশে বেদান্ত কেন্দ্র খুলেছিলেন। সত্যই বিবেকানন্দ অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছিলেন এবং ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির মহান শাস্ত্রজ্ঞ।