উন্নত জীবনের জন্য একটি উপকরণ হিসাবে সঞ্চয়
“ছোট ছোট জলবিন্দু বানাতে পারে সমুদ্র,
ছোট ছোট সঞ্চয় গড়তে পারে বিরাট সৌভাগ্য,
ছোট ছোট পদক্ষেপ তো নিয়ে যেতে পারে ভগবানের কাছে।”
ছোটবেলা থেকেই আমাদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, কারণ এই সঞ্চয়ের অভ্যাসের এক সুদূর প্রসারী ফল আছে,-এই অভ্যাস আমাদের ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গী এমন কি জীবন ধারাই গড়ে দেয়। সঞ্চয় তিনটি স্তরে করতে হয়-পার্থিব স্তরে, মানসিক স্তরে এবং আধ্যাত্মিক স্তরে।
পার্থিব স্তরে আবার দুটো দিক আছে-একটা হল বস্তুর বিষয়ে আরেকটা হল নিজের শরীরের। বস্তুর বিষয়ে আমাদের খাদ্যদ্রব্য, অর্থ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সঞ্চয় করতে হবে। ১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মকালীন শিক্ষা শিবিরে বাবা বলেছেনঃ-
“সত্য সাই সেবা সংস্থায় বাসনা সীমিতকরণে বা চাহিদা নিয়ন্ত্রণের এক চারদফা কর্মসূচী নির্দিষ্ট আছে। এই কর্মসূচী অনুযায়ী সত্য সাই সেবা সমিতির সঙ্গে যুক্ত কেউই খাদ্য, অর্থ, সময় ও শক্তির অপচয় করতে পারে না। খাদ্য, অর্থ, সময় ও শক্তি হল ভগবানের দান। ভগবানের এই চারটি উপহারের অপচয় ও অপব্যাবহার বন্ধ করাটাই হল সাধনা। তা হল আত্মোপলব্ধি লাভের উপায়।” নিজের শরীর বা ব্যক্তিগত দিকে আমাদের দেহের শক্তিকে সঞ্চয় করতে হবে, সঠিক পথে দেহকে ব্যবহার করতে হবে। কম কথা বলে, অযথা কথা না বলে, আজেবাজে কথা না শুনে, বাজে বই না পড়ে, টি.ভি তে সিনেমা বা বাজে জিনিস না দেখে আমরা আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে পারি। ১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মকালীন শিক্ষা শিবিরে বাবা বলেছিলেন, “তুমি যদি তোমার শরীরকে ভগবানের দান বলে মনে কর তখন আর তার অপব্যবহার করবে না, তার উপযুক্ত ও সঠিক ব্যবহার করবে। তেমনি যদি তুমি মনে কর যে, তোমার বুদ্ধি, মেধা ও দক্ষতা ভগবানের উপহার তাহলে সেগুলোকে ভগবানের সেবায়, অপরের সেবাতে নিয়োগ করবে।”
মানসিক স্তরে সঞ্চয়ের দ্বারা আমরা মানসিক শক্তি সঞ্চয় করবো-যাতে করে বিচার-বুদ্ধি, ইচ্ছা-শক্তি, একাগ্রতা ইত্যাদি বেড়ে যায়। গীতায় বলা হয়েছে মনই হল মানষের বন্ধু অবার পরম শত্রু। মন আমাদের উপরে তোলে আবার নীচে নামায়। বিনয়, সহনশীলতা, বন্ধুত্ব, দয়া, ধৈর্য-এসব আমাদের মানসিক সঞ্চয়, মনকে শক্তিশালী করে। আবার ভয়, লোভ, ঈর্ষা, ক্রোধ, উদ্বেগ, গর্ব-এগুলো হল মনের অপচয়, মনকে নষ্ট করে ক্ষয় করে দেয়।
আধ্যাত্মিক স্তরে, প্রত্যেকের ভিতর পরম শান্তি, স্থায়ী শান্তি পাবার একটা ইচ্ছা আছে। আত্মার সঙ্গে মিলন এই শান্তি দেয়। কর্তব্য, ভক্তি ও নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে উপলব্ধি আসে, আত্মার দীপ্তি প্রভাসিত হয়।
পার্থিব ও বস্তুগত স্তরে
আমরা প্রত্যেকেই খাদ্যের গুরুত্ব বুঝি। ক্ষিধের জ্বালা কি আমরা সকলেই জানি। যারা খেতে পায় তারা সৌভাগ্যবান। ভারতবর্ষে কত লোক দুবেলা খেতে পায় না। একটা কথা জানা দরকার যে ভারতে খাবার কম বলে যে লোকে খেতে পায় না তা নয়, খাদ্যদ্রব্যের অপচয়ের ফলেই বহুলোক না খেয়ে মরে। শাস্ত্রে আছে “অন্নং ব্রহ্ম”-অন্নই ভগবান। এই ভগবানকে ফেলে দেওয়া উচিত নয়। তাই যতটুকু বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজন ততটুকু খাব, যতটুকু খাব ততটুকুই রান্না করব, রান্ন করে ফেলে দেব না। মায়েরা জানে ছেলে এতটা খাবে না, তবু অতিরিক্ত স্নেহে বেশী বেশী খাবার তৈরী করে পরে ফেলে দিতে হয়। বাবার কথায় এটা পাপ। এই পাপ করব না। বাড়ীতে দুটো তিনটে ছেলেমেয়ে থাকলে এক একজন একেকটা খাবার পছন্দ করে বলে তিন চার রকম রান্না হয়। এটা পাপ। খাদ্য অপচয় করবই না।
তেমনি পোষাক। যতটুকু দরকার, ভালভাবে সেজে বেরোবার জন্য যা দরকার তার বেশী পোষাক কিনব না। না পরে আলমারীতে ফেলে রাখব না। এতে যে পয়সা বাঁচবে তা দিয়ে ত যারা কাপড় কিনতে পারে না তাদের দিতে পারি। খালি গায়ে যে শীতে কাঁপছে তার ভিতর সাই বাবাইতো কাঁপছেন, এটা মনে রেখে আমাদের কম জামাকাপড় দিতে মাকে বলব, বাকী টাকা দিয়ে গরীব ছেলে মেয়েদের কিনে দিতে বলব।
অপচয় বন্ধ করব। বাড়ীতে কল খোলা দেখলে বন্ধ করব। যে ঘরে লোক নেই, সে ঘরে আলো পাখা জ্বলতে দেখলে সুইচ বন্ধ করব। এই ভাবে জল বিদ্যুৎ বাঁচলে দেশের জল বিদ্যুৎ বাঁচবে, কম লোড শেডিং হবে, গরীবরা জল পাবে।
মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্তর
মানসিক শক্তি সঞ্চয় ও মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রথম প্রয়োজন ভোরে ৫-৩০ মিনিটের ভিতর ঘুম থেকে উঠে একুশবার ও-কার উচ্চারণ করে একটু ধ্যানের অভ্যাস করা। বাবার বলা নিয়ম অনুযায়ী জ্যোতি ধ্যান খুবই কার্যকরী। একটু সময় নীরবে বসতে হবে।
বাবা বলেন আমরা যা দেখি তাই চিন্তা করি, যা চিন্তা করি তাই করি, যা করি তাই আমাদের স্বভাব তৈরী করে দেয়, আর আমাদের স্বভাবই আমাদের ভাগ্য গড়ে তোলে, ভবিষ্যৎ কি হবে স্থির করে দেয়। সুতরাং আমাদের যদি ভাল ভবিষ্যৎ গড়তে হয় তবে ভাল দেখতে অভ্যাস করতে হবে। বাবা বলেন যা চিন্তা করবে তাই বলবে, যা বলবে তাই করবে, এই চিন্তা, বাক্য ও কর্মের সমন্বয়কে বলা হয় ত্রি-কারণশুদ্ধি। তাই প্রয়োজন হল সৎ চিন্তা কারণ ভাল চিন্তা না করলে, খারাপ চিন্তা করলে ত তা বলতে পারব না।
খারাপ বই পড়লে, খারাপ সিনেমা দেখলে, বাজে উপন্যাস পড়লে, মন খারাপ হয়, চিন্তা খারাপ হয়। বাবা বলেন যেমন চিন্তা করবে তেমনি হবে। সুতরাং ভাল হতে হলে, ভাল চিন্তা করতে হবে, আর ভাল চিন্তা করতে হলে খারাপ কিছু পড়ব না, দেখব না-সেই তিনটি বানর, কানে আঙ্গুল, চোখ ও মুখে হাত চাপা দিয়ে আছে, তেমনি-খারাপ কিছু শুনব না, খারাপ কিছু দেখব না, খারাপ কিছু বলব না। বেদে আছে-ভদ্রং পশ্যন্ত, ভদ্রং শ্রুম্বন্ত, ভদ্রং কুর্বস্তু-অর্থাৎ শুধু ভাল দেখব, ভাল শুনব, ভাল কাজ করব।
এ ভাবেই আমরা মানসিক শক্তি শুধু সঞ্চয় নয়, মানসিক শক্তি অর্জন করতে পারব।
অর্থ সঞ্চয়:
জাগতিক জীবনে অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বলা হয় “ধনমূলং ইদং জগত”-এ জগতের মূল হল ধন। “ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ”-এই চারটি পুরুষার্থের ভিতর অর্থের স্থান রয়েছে। তবে এই পুরুষার্থ বলে দেয় যে অর্থ ধর্ম পথে অর্জন করতে হবে, আর বাসনা হবে মোক্ষ লাভের ইচ্ছা। তাই অর্থ ও কামকে ধর্ম ও মোক্ষ-এই দুইয়ের সীমার ভিতর রাখা হয়েছে।
গার্হস্থাশ্রমে; সাংসারিক জীবনে অর্থের প্রয়োজন অনেক। সংসারের বিভিন্ন চাহিদা ছাড়া সামাজিক চাহিদা রয়েছে। একদিকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ীতে উৎসবে নিমন্ত্রণ রাখতে অর্থের প্রয়োজন। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, অসুখ-বিসুখ ইত্যাদির জন্য অর্থের প্রয়োজন। বাবা বলেন, সুখ হল দুটো দুঃখের মাঝখানে একটু বিরতি। তাছাড়া জীবনে উত্থান-পতন আছে। বিপদের দিনের জন্য একটু একটু সঞ্চয় করা প্রয়োজন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে লোক শুধু নিজের পরিবারকে খাওয়ায় সে চোর। তাহলে নিজেদের খাওয়া ছাড়া দরিদ্রদের খাওয়াতে হবে, এর জন্য একটু অর্থ বাঁচানো দরকার। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সঞ্চয় শুধু একটা ভাল কাজ তাই নয়, সঞ্চয় একান্ত প্রয়োজন, নিজেরই বিপদের দিনে সাহায্যের জন্য। একটু একটু সঞ্চয় বিরাট তহবিল গড়তে পারে। একটু যা সঞ্চয় করলাম তা ব্যাঙ্কে রেখে বাড়াতে পারি, নানা সঞ্চয় পরিকল্পনা ব্যাঙ্ক ইত্যাদির রয়েছে। এই সঞ্চয় পরিকল্পনায় যোগ দিলে জাতীয় অর্থনীতির ভাল হয়।
কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার অর্থই সব কিছু নয়। যীশু বলেছিলেন, “লোকে শুধু রুটি খেয়েই বাঁচে না”। পর্থিব সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পদ বাড়াতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে।
বাবা বলেন, “টাকা আসে আর চলে যায়, কিন্তু নৈতিকতা আসে ও বেড়ে যায়”। সংসার জীবনের জন্য যেমন অর্থ সঞ্চয় করব, তেমনি আধ্যাত্মিক জীবন, শান্তিময় জীবনের জন্য মানসিক সঞ্চয় করতে হবে, তা না হলে অর্থ সঞ্চয় হবে কিন্তু সমস্ত জীবনটারই অপচয় হবে। বাবা বলেন “সময়ের অপচয় হয় জীবনেরই অপচয়”-তাই সময় নষ্ট করব না, বসে সময় কাটাব না। একটা না একটা ভাল কাজ করব। আলস্যে দিন কাটাব না, শুয়ে বসে কাটাব না। সময়ের অপচয় না করবার দিকে নজর দেব। বাবা বলেন, “কাজের পরিবর্তনই হল বিশ্রাম”-অর্থাৎ শুয়ে বসে থাকাটা বিশ্রাম নয়, পড়ে উঠে বাড়ীর কাজ করলে বিশ্রাম হয়, বাড়ীর কাজ সেরে বাজার করতে গেলে বিশ্রাম হয়।
বেশ কয়েক বছর আগে প্রশান্তি নিলয়মে যখন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার ব্রাঞ্চ আফিস খোলা হয় তখন বাবা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “এটা হল পার্থিব ব্যাঙ্ক, এছাড়াও আধ্যাত্মিক ব্যাঙ্ক আছে। ব্যাঙ্কে অর্থ সঞ্চয় প্রয়োজনে নিশ্চয়ই উপকার দেবে সন্দেহ নেই। এটা “আস্তি” বা সম্পত্তির কাজ দেবে। কিন্তু এর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সম্পত্তির দরকার। “আস্তিক” অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ঈশ্বরের সেবা আধ্যাত্মিক সঞ্চয় এনে দেব।” সুতরাং প্রয়োজন হল পার্থিব সঞ্চয় ও আধ্যাত্মিক সঞ্চয়ের ভিতর একটা সাম্যতা বজায় রাখা। তা সত্ত্বেও অর্থ সঞ্চয়ের গুরুত্ব কমছে না। সঞ্চয় করে কিপটেমি নয়, অপরের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
শিশুদের জ্ঞাতব্য
শিশুদের পক্ষে সব সময় সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না। কিন্তু তারা বাড়তি বা অযথা খরচ কমাতে পারে। তারা বাবা মায়ের কাছে বেশী কিছু দাবী করবে না। তাদের মনে রাখা উচিত বাবা মা কষ্ট করে রোজগার করছেন, তাদের বড় করে তুলছেন, তারপরে তাদের বেশী কিছু দাবী করা উচিত নয়।
অর্থের অপচয়, খাদ্যের অপচয় হল সামজিক অপরাধ। মিতব্যায়ীতার অভ্যাস হল সঞ্চয়ের অভ্যাসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। নিজের বাসনার উপর সীমারেখা টানা, চাহিদার নিয়ন্ত্রণই হল প্রকৃত সঞ্চয়।
স্মরণ রাখতে হবে
(১) ক্ষুধার্তকে খাবার দেবার জন্য খাদ্য সঞ্চয় করব
(২) দরিদ্রকে সাহায্য করব বলে অর্থের অপচয় করব না
(৩) সকলকে ভালবাসব বলে আস্তে নম্র হয়ে কথা বলব
(৪) ভাল উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজে ও অপরের সেবায় সময় ব্যয় করব
(৫) রোজ প্রার্থনা ও ভগবান বাবাকে স্মরণ ও ধ্যান করব নিজের দেহ, মন ও আত্মাকে সতেজ রাখবার জন্য।