বড়দিন
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে ভগবান যীশুর আর্বিভাব উপলক্ষে বড়দিন উৎসব উদযাপিত হয়। এই সময় যীশুর আর্বিভাব উপলক্ষে যে গীর্জায় যে সমাবেশ হয়, তা থেকে Christmas বা বড়দিন কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। কখন কখনও Christmas কথাটি ছোট করে লেখা হয় ‘X- Mas’। ‘X’ একটি গ্রীক অক্ষর, যা গ্রীসে Christ নামের প্রথম অক্ষর ধরা হয় এবং প্রায়শঃই এই অক্ষর কে শুভ চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
যীশুর জন্ম কাহিনী
যীশু জন্মাবার ঠিক আগেরদিন রোমান শাসক সীজার অগাস্টার্ (Caesar Agustus) রোমবাসীদের উদ্দেশ্যে এক ফরমান জারী করলেন যে প্রত্যেক রোমবাসীকে তাদের পূর্বপুরুষের নগরীতে গিয়ে কর জমা দিতে হবে। সুতরাং যোসেফ ও মেরী ন্যাজারেথের গ্যালীলি শহর থেকে ডেভিডের শহর জুডিয়া (ইহুদী ভাষায় বেথলেহেম) এর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। যোসেফ ছিলেন রাজা ডেভিডের উত্তর পুরুষ। মেরী, যিনি আসন্ন প্রসবা, তিনি একটি গাধার পিঠে চেপে চললেন আর যোসেফ তার পাশে হেঁটে চললেন। কর দেবার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে লোক ভীড় করেছে। সব সরাইখানা ভর্ত্তি। যোসেফ ও মেরী একের পর এক সব জায়গায় ঘুরলেন কিন্তু কোথাও থাকার জায়গা পেলেন না। শেষে মেরীর ক্লান্ত অবসন্ন মুখ দেখে এক পান্থশালার মালিকের দয়া হল এবং তিনি ঐ পান্থশালার পিছনে একটি ছোট আস্তাবলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। যোসেফ ও মেরী খুব কৃতজ্ঞ হলেন এবং সেই রাতের জন্য ঐ পশুদের সঙ্গে ছোট্ট পরিসরে বিশ্রামের জায়গা ভাগ করে নিলেন। সেই রাতে মেরী তাঁর প্রথম পুত্রের জন্ম দিলেন। মেরী ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার গামলায় বিছানা তৈরী করলেন এবং নরম সুভাসিত খড়ের ওপর তাদের জামাকাপড় জড়িয়ে ছোট্ট শিশুকে সর্ন্তপনে শোয়ালেন। বেথলহেম এর ঠিক বাইরে একটা খোলা জায়গায় কতকগুলো মেষপালক আগুন জ্বেলে, তার চারপাশে বসে আগুন পোহাচ্ছিল, আর তাদের মেষের পালের দিকে লক্ষ্য রাখছিল। মেষপালকেরা এক দিব্যদর্শনে ধন্য হল। হঠাৎ্ এক দেবদুত ঐ মেষপালকদের কাছে উপস্থিত হলেন, তাঁর দিব্যজ্যোতিতে চারিদিক উদ্ভাসিত হল। প্রথমে মেষপালকেরা ঐ দিব্যজ্যোতিতে ভয় পেয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরল। কিন্তু দেবদুত বললেন, “ তোমরা ভয় পেওনা, আমি সকলের কাছে এক শুভ আনন্দময় বার্তা নিয়ে এসেছি, রাজা ডেভিডের এই শহরে আজ রাতে সকল মানবের জন্য এক পরিত্রাতা জন্ম নিয়েছেন, তিনি প্রভু যীশু এবং এই চিহ্ন অনুসরণ করে, তাঁকে খুঁজে পাবে। তাঁকে জামাকাপড় জড়িয়ে ঘোড়ার জাবনা খাওয়ার গামলায় শুইয়ে রাখা হবে” এমন সময় অকস্মাৎ স্বর্গের পরীরা এসে আনন্দে ঈশ্বরের গুনগান করতে লাগলেন। তারা গাইতে লাগলেন “ হে সর্বোচ্চ পিতা, তোমার মহিমার জয় হোক। পৃথিবীতে তুমি সকলের মধ্যে শান্তি ও সদিচ্ছা এনে দাও”। মেষপালকেরা অবাক হয়ে গেল এবং পরস্পরের মধ্যে বলাবলি করল, “ চলো আমরা শীঘ্র বেথেলহেমে যাই। প্রভু আমাদের যে বার্তা পাঠিয়েছেন, যা আমাদের মধ্যে এত উৎসাহ এনেছে, চলো দেখি”। তারা দ্রুত ঐ শহরের দিকে রওনা হলেন। ঐ পান্থশালার পিছনে আস্তাবলটিকে দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতে লাগলেন। তারা পিতা যোসেফ, মা মেরী ও ঘোড়ার জাবনা খাওয়ানোর গামলায় শায়িত, গরম কাপড় জড়ানো দিব্যশিশুকে দেখতে পেলেন। ঐ মেষপালকেরা ছোট্ট শিশুর কাছে শ্রদ্ধাবণত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে অভিবাদন করলেন। দেবদুত যা তাদের কাছে ঘোষনা করেছিলেন, তা গভীর ভাবে অনুভব করলেন। প্রভুর দিব্য পরিকল্পনার কথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে, ধীরে ধীরে তাঁর গুণগান করতে করতে ফিরে গেলেন। মেরীর কাছে মেষপালকেরা যা বর্ণনা করেছিল, মেরী গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন ও নিজের মধ্যেই সে কথা রেখেদিলেন। কারুর কাছে প্রকাশ করলেন না।
অনেক শতাব্দী আগের ভবিষ্যত বাণী অনুযায়ী যীশুর জন্ম সময়ে পূর্বদিকের আকাশে একটি উজ্বল তারার উদয় হয়। পূর্বদেশের থেকে তিন জ্যোতিষী আকাশে এই উজ্বল তারা দেখে ইহুদিদের রাজা হেরডের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইহুদীদের ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তা কোথায় জন্মেছেন ?” আমরা পূর্বদিকে ঐ উজ্বল তারা দেখে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করব বলে এসেছি। এ কথা শুনে রাজা হেরড চিন্তায় পড়ে গেলেন। রাজা হেরড তাঁর রাজ্যের পুরোহিত ও জ্যোতিষীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “শাস্ত্রের ঘোষণা অনুসারে যীশু কোথায় জন্মেছেন?” তারা বললেন, “জুডিয়ার অর্ন্তগত বেথেলহেম শহরে”। রাজা হেরডের মনে কোন শান্তি থাকল না। দুষ্ট রাজা হেরড ঐ তিনজন পন্ডিতকে বললেন শিশুটির সন্ধান পেলে তাকে যেন জানানো হয়, যাতে তিনি নিজে গিয়ে পুজো দিতে পারেন।
ঐ উজ্বল আলোককে অনুসরণ করে ঐ তিন জ্যোতিষী দেখল,এক জায়গায় সেই আলোটি কেন্দ্রীভূত হয়েছে,সেখানেই প্রভু যীশু শুয়ে আছেন। মেরীর সাথে ঐ দিব্য শিশুকে দেখে হাঁটু গেড়ে নত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অভিবাদন করলেন। তারা সঙ্গে এনেছিলেন এক বাক্স স্বর্ণমুদ্রা, একটি খোদাই করা বাক্সে সুগন্ধি এবং একটি ছোট শিশিতে মাখানোর জন্য গন্ধরস যুক্ত তেল। তারা এই ভক্তি উপহার নিবেদন করলেন। দেবদূত জ্যোতিষীদের স্বপ্নে এসে, রাজা হেরডের কাছে না গিয়ে, ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। সুতরাং তারা অন্যপথে তাদের দেশে ফিরে গেলেন।
এদিকে যোসেফ স্বপ্নে দেখলেন ঈশ্বরের দেবদূত এসে তাকে বললেন “ ওঠো, মা ও সদ্যোজাত শিশুকে নিয়ে শীঘ্র ঈজিপ্ট দেশে পালিয়ে যাও, যতদিন না আমি ফেরার নির্দেশ দেবো, ততদিন ওখানে থাক। রাজা হেরড ছোট শিশুদের হত্যা করবে”। যোসেফ যখন ঘুম থেকে উঠলেন, তিনি মেরীকে স্বপ্নের কথা জানালেন। তারা শীঘ্র তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন, মেরী ও সদ্যোজাত শিশুকে কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে ছোট্ট গাধার পিঠে চেপে সেই গভীর রাত্রে নিঃসঙ্গ প্রান্তর ঈজিপ্ট এর উদ্দেশ্যে দীর্ঘ দক্ষিনমুখী যাত্রা শুরু করলেন।
যখন দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছে, রাজা হেরড বুঝতে পারলেন যে তিনি ঐ জ্যোতিষীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, তিনি রাগে ফেটে পড়লেন, তিনি বলতে লাগলেন “একটা ছোট্ট শিশু আমার সিংহাসন কেড়ে নেবে,এ আমি হতে দেব না”। তিনি এতই ক্রোধান্বিত ছিলেন যে আদেশ করলেন ,“বেথেলহেম ও উপকুলবর্ত্তী এলাকায় যত দুবছর বয়সের মধ্যে শিশু আছে, তাদের হত্যা করো।” হেরডের আদেশে দুবছর বয়সের মধ্যে যত শিশুকে বধ করা হল।
কিন্তু হেরড মারা যাবার পর, ঈশ্বরের দুত যোসেফের স্বপ্নে এসে জানালেন, “তুমি এখন মা ও ছেলেকে নিয়ে ইসরায়েল ফিরে যাও”।
সুতরাং ঐ ছোট্ট পরিবার আবার দুস্তর মরুভূমি পার হয়ে দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু ছোট্ট শিশুর জীবন নিরাপদ ভেবে যোসেফ ও মেরী খুব খুশী হলেন। তারা তাদের নিজ শহর, গ্যালিলি প্রদেশের ন্যাজারেথে, ফিরে গেলেন।