ভজ গোবিন্দম
গোবিন্দের অনুসন্ধান করো, ঈশ্বরের অনুসন্ধান করো
‘গোবিন্দের অনুসন্ধান করো ঈশ্বরের অনুসন্ধান করো, ভজ গোবিন্দম,’- ভজ ও গোবিন্দ এই দুটি শব্দে গঠিত এই নীতিবাক্যে শ্রী শঙ্কর ভগবদপাদ, মানুষের মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজন সমগ্র বেদান্ত ও ধর্মশাস্ত্রর শিক্ষার মূলকথা সংক্ষেপে প্রচার করে গেছেন। এটিই আমাদের হাতে শ্রী গোবিন্দের নিবাস স্থলে, পরম শান্তি ও আনন্দের রাজ্যে প্রবেশ করার ছাড়পত্র বা চাবিকাঠি অর্পণ করে এবং আমাদের পার্থিব জীবনের দুঃখকষ্টের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য আমাদের বর্তমান কালের জীবন যাত্রা।
আমরা যাতে সহজেই বুঝতে পারি সেইজন্য, সহজবোধ্য ও পরিচিত উপমা ও উদাহরণ সহযোগে, একত্রিশটি সরল স্বচ্ছ সুমিষ্ট শ্লোকের মাধ্যমে জীবনের ভ্রম বিভ্রান্তি ও অসারতা ও অর্থহীনতা সম্পর্কে শংকর আমাদের বলে গেছেন এবং একটির পর একটি শ্লোকের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে থেকে একটির পর একটি পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদের অজ্ঞতা বিভ্রান্তি মায়া মোহ দূর করেছেন। তিনি আমাদের জীবনের দূঃখ কষ্ট যন্ত্রণা নিরসনের উপায় বলে দিয়েছেন। এই কবিতাকে তাই ‘ মোহ মুদগর’ বলা হয়। তিনি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক ও বিষয়কে স্পর্শ করে গেছেন, তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে তা আমাদের অন্ধ করে দেয়, বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখে এবং অজ্ঞতা ও দুর্দশার গভীর অতলে নিক্ষেপ করে। তিনি চান আমরা প্রত্যেকে যেন পার্থিব আকর্ষণ বিকর্ষণ থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে চিরন্তন সত্য সেই গোবিন্দকে উপলব্ধি করার জন্য বৈরাগ্য সাধনার অনুশীলন করি ও বিচক্ষনতার সাথে বিবেকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শ্বাশতকে ক্ষণস্থায়ী থেকে সত্যকে অসত্য থেকে আলাদা করে চিনে নিতে পারি। এভাবেই আমরা বাহ্যিক পার্থিব অস্তিত্বের দুর্দশা ও বন্ধন থেকে মুক্তি পাবো।
জগৎবন্ধু আদি শঙ্করাচার্য হলেন ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর অবিসংবাদিত অবিতর্কিত শ্রেষ্ঠ মহান দার্শনিক ও তার মত দার্শনিক পৃথিবীতে আর কখনও জন্ম গ্রহণ করেনি। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অদ্বিতীয় কারণ তার মধ্যে আমরা দার্শনিক, ভক্ত, কবি, অতীন্দ্রিয়বাদী ও ধর্মসংস্কারকের সবরকম গুণাবলী দেখতে পাই। যদিও তিনি বারো’শ বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিলেন, ভারতবর্ষ তথা পৃথিবী আজও তার জীবন ও কাজের আধ্যাত্মিক প্রতিভার প্রভাব অনুভব করে।
‘গীতা’য় ঘোষিত প্রতিজ্ঞা অনুসারে ঈশ্বর স্বয়ং মনুষ্য রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন যখন ধর্ম ও ধর্মাচারণ বিলুপ্তপ্রায় হয়। নৈতিক ও ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা ও অবক্ষয় যখন সম্পূর্ণ দেশকে গ্রাস করেছে, ঠিক সেই সময় শঙ্করাচার্য ভারত ভূমিতে অবতীর্ণ হন।
আটের দশক বা অষ্টম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় সারা দেশ জুড়ে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল কিন্তু তা প্রভু বুদ্ধের পবিত্র সরল নৈতিক শিক্ষা থেকে ভিন্ন ও পরিবর্তিত। সেই সময় জৈনধর্মের প্রভাবও এই দেশে যথেষ্টই ছিল ও প্রচুর মানুষ এই ধর্মের অনুসারী ও অনুগামী ছিলেন। দুটি ধর্মই সাধারণ বোঝাপড়া ও সাধারণ মানুষের বোধগম্যতা অনুযায়ী ঈশ্বর সম্পর্কিত সঠিক ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ফলস্বরূপ নাস্তিকতাই তখন জনসাধারণের মধ্যে একটা রেওয়াজ বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। হিন্দুধর্ম নিজেই অসংখ্য সম্প্রদায় ও দল উপদলে বিভক্ত ছিল। দেশের ধর্মীয় সাম্য হারিয়ে যাচ্ছিল তাছাড়াও ধর্মের নামে কিছু অস্বাস্থ্যকর, বিশদৃস আচারের অনুপ্রবেশ ঘটছিল; যেমন শৈবদের শপথ, শাক্তদের বামাচার; গাণপত্য, সৌর এবং ভাগবতদের কিছু আচার। এগুলি ধর্মের শুদ্ধতা ও মানসিকতাকে নষ্ট করে দিচ্ছিল। হিন্দু ধর্মের অবনমন, অসামঞ্জস্য, বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যেকার বিরোধ, এইসব জিনিষকে রোধ করবার জন্য সেই সময় প্রয়োজন ছিল সকল মতের সমন্বয়কারী একটি মতাদর্শ। একমাত্র তাহলেই ধর্মের সনাতন নীতিগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল। তাহলেই ফিরিয়ে আনা যেত, নৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্য; সম্ভব ছিল তাদের মিলন। দেশে আসত নবজাগরণ। এই রকম মহৎ বিশাল ও বিষ্ময়কর কাজ একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষেই করা সম্ভব। শঙ্করাচার্য এলেন, সেই কাজের ভার গ্রহণ করলেন ও সেই কার্য সম্পন্ন করলেন।
শঙ্কর, তার ৩২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনকালের মধ্যেই অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনকে হিন্দু ধর্মের অপরিহার্য ঐক্যবদ্ধ ভিত্তি হিসেবে দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তিনি দেশে ধর্মীয় ঐক্য, আধ্যাত্মিক সমন্বয় নৈতিক পুনরুত্থান ঘটিয়েছিলেন।