শঙ্করের জীবনী
শঙ্করাচার্য অষ্টম শতকে মধ্য কেরালায়,কালাডি নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তিনি এক নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দম্পতির একমাত্র সন্তান ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল শিবগুরু ও আর্যাম্বা। এইরকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে ত্রিচূড়ের বৃষভচলেশ্বর মন্দিরে শিবের কাছে দীর্ঘ কাল প্রার্থনার ফলে তাঁর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন এক বিস্ময় বালক এবং মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর বেদ অধ্যয়ন সমাপ্ত হয়। শঙ্করের শৈশবেই তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। আর্যাম্বাই পরম ভালোবাসা ও যত্নে তাঁকে বড় করে তোলেন। তখন শঙ্করই ছিলেন তাঁর একমাত্র স্বান্ত্বনা ও সহায়। শঙ্করের মধ্যে বৈরাগ্যের ভাব দেখা দেওয়ায় আর্যাম্বা খুবই চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু যে দিব্য উদ্দেশ্যে এই প্রতিভাধর বালক জন্ম নিয়েছেন তার বাস্তবায়নের জন্য একটি চমৎকার হতেই হতো কারণ সেটাই তাঁর পার্থিব বন্ধনকে ছিন্ন করবে। সুতরাং একদিন এই বালক যখন কাছেই পূর্ণা নদীতে চান করছিল এবং তাঁর মা তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একটি কুমীর এসে ছেলেটির পা কামড়ে ধরল। তখন সেই বালক মায়ের কাছে মানুষের শেষ আশ্রম অর্থাৎ সন্ন্যাস আশ্রমে প্রবেশ করার অনুমতি চাইল। প্রত্যেক হিন্দুরই মৃত্যুর আগে এই আশ্রম গ্রহণ করার বিধান আছে। আপদকালে প্রথাগত ভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ খুবই প্রচলিত রীতি ছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আর্যাম্বা মত দিলেন। অবাক কান্ড! কুমীর সঙ্গে সঙ্গে বালকের পা ছেড়ে দিল। নদী থেকে উঠে এসে, সেই বালক সন্ন্যাসী স্থির করলেনযে তিনি ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী হবেন। মাকে স্বান্ত্বনা দিয়ে এবং তাঁকে কথা দিয়ে যে মায়ের শেষ সময়ে তিনি তাঁর কাছে আসবেন ও তাঁর শেষকৃত্য করবেন, শঙ্কর গ্রাম ত্যাগ করলেন। তারপর শঙ্কর যে কাজের জন্য ঈশ্বর তাঁকে পাঠিয়েছেন, সেই উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র আট বছর। তাঁর বয়সী বালকেরা তখনও খেলনাপত্র নিয়ে মেতে আছে।
কালাডি ত্যাগ করে শংকর গুরুর সন্ধানে দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিক্রমা করে অবশেষে নর্মদার তীরে এসে পৌঁছলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হল গোবিন্দপাদ এর। ইনি ছিলেন মান্ডুক্য কারিকা খ্যাত গৌড়পাদ স্বামীর প্রধান শিষ্যদের অন্যতম। গোবিন্দপাদ সাদরে তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করে নিলেন ও বেদান্তের গহীন তত্ত্বে তাঁকে দীক্ষিত করলেন। সাত বছর পরে শঙ্করের বেদান্ত অধ্যয়ন ও সাধনা সমাপ্ত হলে তাঁর গুরু তাঁকে কাশী যেতে নির্দেশ দিলেন। কাশী ছিল প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান। গুরু বললেন যে শংকর যেন সেখানে গিয়ে ব্রহ্মসূত্র, উপনিষদ ও ভগবৎ গীতার ওপর ভাষ্য রচনা করে অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা সম্প্রচার করেন। গুরুর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি কাশী গেলেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেদান্ত শাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন।শংকর বহু বিতর্ক সভায় বিজয়ী হলেন এবং তাঁর কাছে বহু শিষ্যের সমাগম হল। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন পদ্মপাদ, হস্তামলক ও তোটক। এইভাবে মাত্র ষোলো বছর বয়সে শঙ্কর বারাণসীতে নিজেকে এক মহান দার্শনিক রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। কাশী তখন ছিল বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিকতার প্রাণকেন্দ্র।
কাশীতে নিজেকে বেদান্তের অজেয় প্রবক্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পর শঙ্কর, সুবিশাল এই ভারতে এক দিগ-বিজয় যাত্রা শুরু করলেন।এটির উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক বিজয়। তিনি যখন ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য রচনা করছিলেন তখন স্বয়ং বেদব্যাস তাঁকে স্বপ্নে এই বিষয়ে বিশিষ্ট নির্দেশ দেন I শঙ্কর যেখানেই গেলেন সেখানেই অন্যান্য খ্যাতনামা পণ্ডিত যাঁরা ভিন্ন দর্শন মতে বিশ্বাসী তাঁদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে বিজয়ী হলেন।তিনি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর অদ্বৈত বেদান্তকে প্রতিষ্ঠা করলেন।তাঁর অগাধ পান্ডিত্য, তর্কে পারদর্শিতা ও আধ্যাত্মিক দূরদৃষ্টির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না। এগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মণ্ডন মিশ্রের সঙ্গে তাঁর তর্কযুদ্ধ। মণ্ডন মিশ্র ছিলেন কুমারিল ভট্টের শিষ্য এবং কর্মকান্ডের একনিষ্ঠ অধিবক্তা। সেই সময় হিন্দু ধর্মে বেদের কর্মকান্ডের খুব বেশী প্রভাব ছিল। তার কারণ ছিল কুমারিল ভট্ট ও মণ্ডন মিশ্রের মতন দার্শনিক নেতা ও ধর্ম বিশারদদের প্রভাব। জ্ঞানকাণ্ডের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই দুই মহাপন্ডিতকে তর্কে পরাজিত করে বিজয়ী হওয়া শঙ্করের পক্ষে অপরিহার্য ছিল। সেই সময় কুমারিল ভট্ট অগ্নি প্রবেশ করছিলেন। এটি একটি রীতি ,যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে এর ফলে আত্মা জড় ও সংসারিক বন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করে।তাই কুমারিল ভট্ট নিজে তর্কসভায় যোগ দিতে অপারগ হওয়ায় তিনি বেদান্তী শঙ্করকে তাঁর শিষ্য মণ্ডন মিশ্রের সঙ্গে দেখা করে তর্ক করতে বলেন। তিনি এও বলেন যে ওই তর্কের বিচারক হবেন উভয় ভারতী, মণ্ডন মিশ্রের বিদুষী স্ত্রী। বহুদিন ধরে তর্ক চলার পর মণ্ডন মিশ্র পরাজয় স্বীকার করে নেন।
তর্কের শর্ত ছিল যে যিনি পরাজিত হবেন তিনি অন্যজনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন ও তাঁর জীবনাদর্শ মেনে নেবেন। অতঃপর মণ্ডন মিশ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন ও তাঁর নাম হল সুরেশ্বর। এই জয় শঙ্করের বিজয় অভিযানে এক নতুন মাত্রা এনে দিল। শ্রী শঙ্কর ও তাঁর শিষ্যেরা সারা দেশ ঘুরে অন্য মতগুলিকে মিথ্যা প্রমাণিত করলেন এবং ধর্মের নামে যে আপত্তিকর আচারগুলির প্রচলন ছিল সেগুলিকে শুদ্ধ করলেন। তিনি চার জায়গায় মঠ প্রতিষ্ঠা করলেন। দক্ষিণে শৃঙ্গেরী, উত্তরে বদ্রী, পশ্চিমে দ্বারকা এবং পূর্বে পুরীতে জগন্নাথধাম। বলা হয় যে কাঞ্চিতেও তিনি একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যার নাম কামকোটি মঠ। তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই জায়গাগুলিকে নির্বাচন করেছিলেন। বরফে ঢাকা পাহাড় ,অরণ্য, নদী ও সমুদ্র তট। এই জায়গাগুলিতে যেন মনে হয় স্বর্গ এসে পৃথিবীর সঙ্গে মিলেছে। স্থানমাহাত্ম্য মানুষের মনকে কোন সুদূর উচ্চতায় নিয়ে চলে যায়। শঙ্করাচার্য সুরেশ্বরাচার্যকে শৃঙ্গেরী মঠের দায়িত্ব দেন, দ্বারকার দায়িত্ব দেন শ্রী পদ্মপাদকে, বদ্রীর দায়িত্ব পান তোটক এবং পুরীর দায়িত্ব পান হস্তামলক। এই মঠ প্রতিষ্ঠা করা থেকে যা সূচিত হয় তা হল, শঙ্কর ভারতের ভৌগোলিক ও আধ্যাত্মিক একত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।সেই সময়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে মত বিনিময়ের উপযুক্ত ভাষা হিসাবে তিনি সংস্কৃতকে বেছে নেন। শঙ্করের সকল রচনার ভাষা সংস্কৃত। তাঁর মনে হয়েছিল যে এই ভাষাই দেশের সকল প্রান্তের বিদ্বৎজনেরা গ্রহণ করবেন। শৃঙ্গেরীতে একটি দীর্ঘ দিন যাপনের পর শঙ্কর তাঁর পূর্বাশ্রম কালাদিতে তাঁর মুমূর্ষু মায়ের শয্যার পাশে ছুটে গেলেন। শিব ও বিষ্ণুর সুললিত বন্দনার সঙ্গে তাঁর মায়ের আত্মাকে অমৃতলোকে প্রেরণ করলেন।তিনি তাঁর ধর্মীয় সতীর্থদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে , বাড়ির পিছনে, নদীর তীরে তাঁর মায়ের মরদেহ দাহ করলেন। স্থানটি বর্তমানে একটি তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
ভারতের যে সমস্ত পবিত্র মন্দিরগুলি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পীঠস্থান, সেই সব মন্দির শঙ্কর দর্শন করেন। সেগুলির পূজাপদ্ধতির সংস্কার সাধন করেন এবং বেশ কয়েকটিতে শ্রীচক্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার মধ্যে আছে কাঞ্চীর কামাক্ষী মন্দির, বদ্রীর নরনারায়ণ মন্দির, নেপালের গুহ্যেশ্বরী মন্দির ইত্যাদি।
এই পরমহংস পরিব্রাজকাচার্যঃ কাশ্মীরের বিদগ্ধ পন্ডিতদের পরাজিত করে তাঁর বিজয় অভিযানের রাজ্ শিরোপা লাভ করেন। তিনি সর্বজ্ঞ পীঠে আরোহণ করেন। এটি হল সমগ্র বিশ্বে তাঁর পান্ডিত্য ও তৎকালের সকল বিদ্যা বিষয়ে তাঁর সংশয়াতীত আধিপত্যের স্বীকৃতি।
শেষবার তিনি যখন নেপালে যান, সেখানে তিনি শ্রী দত্তাত্রেয়ের দিব্য মানস দৰ্শন লাভ করেন। এরপর তিনি কেদারনাথে যান এবং সেখানে ৩২ বছর বয়সে তিনি সশরীরে অন্তর্ধান করেন। কেদারনাথের মন্দিরের অদূরে একটি স্থানকে তাঁর অন্তর্ধানের ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করা হয়। (আরেকটি মতে তিনি কাঞ্চীতে কামাক্ষী মাতার মধ্যে লীন হয়ে যান। এইভাবেই তিনি তারঁ ইহলীলা সংবরণ করেন।)
ঔপনিষদিক দর্শনের যুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার দ্বারা শঙ্কর হিন্দু ধর্মের সৌধ রচনা করেন। সেই শক্তিতে ইতিহাসের সকল উত্থান পতনের মুখোমুখি হয়েও সনাতন ধৰ্ম আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় দর্শনে তাঁর অবদান এত বিশাল ও চিরস্থায়ী যে, শঙ্কর পরবর্তী কালের দার্শনিকেরা হয় তাঁর দর্শনকে খণ্ডন করতে চেষ্টা করেছেন অথবা তাঁর দর্শনের ওপর ভাষ্য রচনা করেছেন। ভারতের বাইরে ভারতীয় দর্শন বলতে শঙ্করের অদ্বৈত মতকেই লোকে বোঝে।
ঋষি পরম্পরার যে মহান ঐতিহ্য, শঙ্কর তার প্রতীক এবং তার ভাষ্যকার। শঙ্কর আশাবাদী, তিনি আশার বার্তা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন যে মানুষ সম্পূর্ণ নয় বা এটি পরম অবস্থা নয়। তার মধ্যে দিব্য শক্তি বর্তমান। আত্মসচেতন বিবর্তনের দ্বারা তাকে আবিষ্কার করতে হবে। অদ্বৈত মতে আমাদের সবার মধ্যে, শান্তি, পরিপূর্ণতা ও আনন্দের রাজ্য বিরাজ করছে।আমাদের সেটি উপলব্ধি করতে হবে। তাঁর নামের আক্ষরিক অর্থ হল যিনি আশীর্বাদ করেন (শম করোতি ইতি শঙ্কর) I যেসব মহামানবেরা মানবজাতির কল্যাণ সাধন করেছেন, শঙ্কর তাঁদের অন্যতম। তিনি যে অদ্বৈত দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন, তা বেদের সার এবং আনন্দ ও অমৃতত্বের পথপ্রদর্শক।