জ্যোতি ধ্যান
“ধ্যানের বিধি সম্বন্ধে বিভিন্ন শিক্ষক বিভিন্ন প্রকার উপদেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমি এখন সবচেয়ে সার্বজনীন এবং সবচেয়ে কার্যকরী ধ্যানের প্রণালী সম্পর্কে বলছি। এটি হল আধ্যাত্মিক নিয়মানুবর্তিতার প্রথম সোপান। প্রথমদিকে প্রত্যহ কয়েক মিনিট এর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখবে এবং পরে পরমানন্দ অনুভূতির পরিমাণের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় বাড়িয়ে দেবে।
এই ধ্যানের সময় সূর্যোদয়ের পূর্বাহ্নে হলেই ভালো হয় কারণ তখন শরীর প্রফুল্ল থাকে এবং দিনের কাজকর্মের চাপ তখনও এসে পড়ে না। তোমার সামনে এমনি একটা প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ অথবা মোমবাতি রাখ, যার শিখা হবে উন্মুক্ত অকম্পিত ও ঋজু। পদ্মাসনে অথবা কোনো সুখাসনে বসে প্রজ্জ্বলিত শিখার দিকে সোজাসুজি কিছু সময়ের জন্য তাকিয়ে থাক এবং আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে ওই শিখাকে তোমার ভিতরে দুই ভ্রুর মাঝখানে অনুভব করো তারপর ধীরে ধীরে জ্যোতিকে (অর্থাৎ শিখাকে) সমস্ত পথ আলোকিত করতে করতে তোমার হৃদয় পদ্মে নিয়ে আসবে। জ্যোতি যখন হৃদয়ের প্রবেশ করবে তখন কল্পনা করতে থাকবে যেন পদ্মের পাপড়িগুলি একটা একটা করে খুলে যাচ্ছে – যাতে তোমার প্রতিটি চিন্তা অনুভূতি ও আবেগ ওই জ্যোতিতে (দীপ শিখার আলোতে) অবগাহন করে নিচ্ছে এবং সেগুলোর ভিতরকার কালিমা মুছে যাচ্ছে। তখন অন্ধকারের লুকিয়ে থাকার আর কোন স্থান থাকবে না। জ্যোতির আলো ক্রমশ বড় ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কল্পনা করতে থাক ধীরে ধীরে সেই জ্যোতি শিখা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছড়িয়ে যাচ্ছে। ওই সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আর কোন অসৎ সন্দেহজনক বা পাপ কাজে লিপ্ত হবে না কারণ সেগুলো এখন আলো ও প্রেমের বাহক। এর পর শিখা জিহ্বা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়াতে সেখান হতে মিথ্যা অপসারিত হল। কল্পনা করতে থাক আলোকশিখা চক্ষু ও কর্ণ পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে সেখানে যে কামনা-বাসনা তোমার দৃষ্টিকে বিকৃত করে তোমায় কিছু আলোচনায় ব্যাপৃত করে রাখতো তাদের বিনষ্ট করল। তারপর তোমার মস্তিষ্ক আলোকিত হলো এই জ্যোতির শিখায়- সমস্ত অপ্রয়োজনীয় চিন্তা সেখান হতে নির্বাসিত হল। তুমি চিন্তা করতে থাকো যে তোমার অস্তিত্বই সম্পূর্ণভাবে আলোকে নিমজ্জিত হয়ে গেল। তোমার চারধারে শুধু অখন্ড আনন্দময় জ্যোতি বিরাজ করছে। তোমার দেহ হতে নির্গত জ্যোতি ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে! ভিতরে নিমজ্জিত হচ্ছে তোমার প্রিয় জন তোমার নিকট আত্মীয় স্বজন তোমার বন্ধু-বান্ধব, শুধু তাই নয় তোমার শত্রু, তোমার মিত্র, বিশ্বের সকল স্ত্রী-পুরুষ, সমস্ত প্রাণী, নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সবকিছুই সেই জ্যোতির ভিতর সচ্চিদানন্দে নিমজ্জিত।
জ্যোতি ইন্দ্রিয় গুলিকে গভীরভাবে ও নিয়মিতভাবে আলোকিত করার ফলে এমন এক সময় আসবে, যখন অসৎ ও অবাঞ্ছিত ও অসৎ আলোচনা করবার ইচ্ছা, অস্বাস্থ্যকর ও মাদক যুক্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করা, মালিন্য যুক্ত বস্তু স্পর্শ করা অথবা অস্বাস্থ্যকর স্থানে যাওয়া অথবা কখনো কারো বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার আগ্রহ আর তোমার অন্তরের স্থান পাবে না। সব কিছুকেই জ্যোতির্ময় দেখবার যে উত্তেজনা বা শিহরণ তাতেই সব সময় নিমজ্জিত থাকবে তুমি এখন যে রূপে ভগবান কে আরাধনা করছ সেই রূপকে সর্বত্র বিরাজমান জ্যোতির আলোকের ভিতর উপলব্ধি করতে চেষ্টা কর। কারণ জ্যোতিই হল ভগবান, ভগবানই হলেন জ্যোতি।
ধ্যান সম্পর্কে আমি যে উপদেশ দিলাম তা প্রত্যহ নিয়ম করে অভ্যাস করবে। অন্য সময়ে ভগবানের কোন নাম (ভগবানের অসংখ্য মহিমার কোন একটির সঙ্গে যুক্ত যে কোনো নাম) জপ করবে এবং সবসময় ঈশ্বরের শক্তি, অপার দয়া ও বদান্যতার প্রতি সজাগ থাকবে।”
[শ্রী সত্য সাই স্পীকস দশম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৪৮-৩৫০, শিবরাত্রি, ১৯৭৯]