রামের বিরহে ভরতের শোক
নিদ্রাহীন ভরত সারারাত শুধু কাঁদছেন। ইচ্ছে করছে এখুনি বনে গিয়ে রামের চরণে পড়েন। এইভাবে প্রভাত হলো। ভরত ও শত্রুঘ্ন, মাতৃগণ, বশিষ্ঠদেব সৈন্যবাহিনী ও শত শত নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যা ত্যাগ করলন। দুদিনপর তাঁরা গঙ্গাতীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপজাতি সর্দার গুহক ভাবলেন ভরত বুঝি রামের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য সৈন্যবাহিনী এনেছেন। তিনি ভরতকে পরীক্ষা করতে চাইলেন।
গুহক ভরতের সম্মুখীন হলেন। ভরতের সাদৃশ্য ছিল রামের সঙ্গে। দুঃখে শোকে, তার চোখ দুটি ঈষৎ লাল, পরিধানে বল্কল, অতিকষ্টে তিনি জানালেন যে রামকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার জন্যেই তিনি বনে যাচ্ছেন। গুহক তার ভুল বুঝতে পারলেন।
ভরদ্বাজ ঋষিও ভরতকে পরীক্ষার জন্য বললেন, ‘রামকে যদি হত্যা করতে চাও, তবে আমি তার গতিবিধি বলে দিতে পারি।’ একথা শুনে দুঃখে ভরত মুহ্যমান হলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘মুনিবর, আপনি ভাবতে পারলেন আমি এত নীচ?’ ঋষি বুঝলেন ভরতের মন। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং সকলের যথোচিত আপ্যায়ণের ব্যবস্থা করলেন।
পরদিন প্রাতে ঋষিবর চিত্রকূট পর্বতাভিমুখে পথ দেখিয়ে দিলেন। সেখানে রাম লক্ষ্মণ কুটির নির্মাণ করে আনন্দে বসবাস করছিলেন। প্রকৃতির অফুরন্ত শোভা দর্শনে সীতা তৃপ্তিলাভ করলেন।
একদিন রাম লক্ষ্মণ ও সীতা বিশ্রাম করছিলেন—এমন সময় তারা কোলাহল শুনতে পেলেন। লক্ষ্মণ বৃক্ষে আরোহণ করে চারদিক দেখে সত্বর নেমে এলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘দাদা, ভরত মনে হয় আমাদের বন্দী করার জন্যে বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছেন। আমার হাতে ওর মৃত্যু আছে। রাম কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন, লক্ষ্মণ, ভরত কখনও ইক্ষ্বাক্ষু বংশকে কলুষিত করবে না। আমি তার প্রেমভক্তি জানি, তুমি সিংহাসন চাইলে আমি তোমাকে সিংহাসন দিতে বলবো।’
রামের কথায় লক্ষ্মণ আহত হলেন। লজ্জিত লক্ষ্মণ রামের কাছে ক্ষমা চাইলেন। ভরতের আগমণের জন্য সকলে উৎসুক হয়ে রইলেন। ভরতের তপস্বীর বেশ দুঃখে স্নান মুখ ; তিনি রামের চরণতলে পতিত হলেন। রাম তাকে সম্নেহে তুলে নিবিড় আলিঙ্গনে বাঁধলেন, সকলের চোখে জল।
রাম অযোধ্যার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। রাজ্য শাসন কেমন হচ্ছে জিজ্ঞাসা করায় ভরত বললেন, তুমি কি মনে কর আমি রাজ্য শাসন করছি! আমাদের বংশে জ্যেষ্ঠ রাজ্যশাসন করে। তুমি চল, এবং শাসনভার গ্রহণ কর। পিতার মৃত্যু সংবাদে রাম মুর্চ্ছিত হলেন। পরে শান্ত হলে চারভাই মন্দাকিনী নদীতীরে পিতার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেলেন।
ফিরে এসে আসন গ্রহণ করার পর ভরত বললেন ; পিতার মৃত্যুর পর রাজ্যে শুধু হাহাকার, অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা। সিংহাসনে আমার কোন অধিকার নেই। তাই এসেছি তোমায় ফেরাতে। তুমি ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা কর। আমার মা কৈকেয়ী, যিনি তোমার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী তিনি আজ অনুতপ্ত। রাম বললেন, সকলের স্নেহ ভালবাসা পেয়ে আমি ধন্য। মাতা কৈকেয়ীকে দোষ দিও না ; পিতাকেও না। আমরা সবাই নিয়তির বশ। পিতার ইচ্ছা ছিল আমার বনবাস ও তোমার রাজ্যশাসন। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাঁর আত্মা তৃপ্তি পাবে।
ভরত অবিচলিতভাবে বললেন, আমি তোমাকে না নিয়ে অযোধ্যা নগরীতে ফিরব না। আমার কোন অধিকার নেই সিংহাসনে। সুতরাং লক্ষ লক্ষ প্রজাদের ও মায়েদের মুখ তাকিয়ে ফিরে চল। রাম কিছুতেই ফিরবেন না। ভরত জানালেন রামের প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি প্রায়োপবেশন করবেন। এমতাবস্থায় গুরু বশিষ্ঠই এগিয়ে এলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন, ‘রাম বনবাস থেকে না আসা পর্যন্ত ভারত রাজশাসন করবে। সকলে এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।
তখন ভরত কললেন, দাদা, দয়া করে তোমার পাদুকা দুটি দাও। আমি সিংহাসনে ও’দুটি স্থাপন করে রাজ্য পরিচালনা করবো। আমি থাকবো কুঁড়ে ঘরে তপস্বীর মত। চোদ্দবছর পর তুমি যদি না ফের, তবে অগ্নিতে এ প্রাণ বিসর্জন দেব। সমবেত সকলে ভরতের চরিত্রে মাধুর্য্য মুগ্ধ ও বিস্মিত। রামের আশীর্বাদ নিয়ে সকলে অযোধ্যার দিকে রওনা হলেন।
প্রশ্নঃ
- ভরত কেন রাজা হতে অস্বীকার করলেন?
- রাম কেন অযোধ্যায় ফিরতে চাইলেন না?
- বশিষ্ঠ কি ভাবে এই সমস্যার সমাধান করলেন যাতে সকলেই সন্তুষ্ট হলেন?