ভরতের প্রত্যাবর্তন
রাম বনে গেলেন, শোকে মুহ্যমান রাজা দশরথ হলেন শয্যাশায়ী, দিনরাত কাঁদেন আর বলেন ‘হায় রাম, সীতা, লক্ষ্মণ।’ তার অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগলো এবং একদিন রাত্রিতে রাম নাম উচ্চারণ করতে করতে তিনি প্রাণত্যাগ করলেন। সারা রাজ্যে নামলো শোকের ছায়া। একদিকে রামের নির্বাসন, অন্যদিকে প্রিয় রাজার মৃত্যুতে অযোধ্যাবাসী কাতর হয়ে পড়লো। গুরু বশিষ্ঠদেব তৎক্ষণাৎ ভরত ও শত্রুঘ্নকে আনতে লোক পাঠালেন তাদের মাতুলালয়ে। দুইভাই সত্বর অযোধ্যায় ফিরে এলেন। নগরে প্রবেশ করেই ভরত দেখলেন সর্বত্র এক অস্বাভাবিক অবস্থা। কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। তিনি সোজাসুজি মায়ের কাছে এলেন—তাঁর প্রথম প্রশ্ন—’বাবা কোথায়? যিনি সবসময় আমায় স্নেহভরে কাছে ডাকতেন?
রাম-লক্ষ্মণ কই—কেন তাদের দেখতে পাচ্ছি না? কৈকেয়ী তক্ষুনি মন্থরাকে ডাকলেন ভরতকে সবকথা বলার জন্য। দাসী মন্থরা খুব উৎসাহ নিয়ে ভরতকে বললো—“প্রিয় পুত্র, আমরা তোমার জন্যে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। পথ পরিষ্কার। তুমি হবে অযোধ্যার রাজা। ঈশ্বর মহান। আমাদের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। সুতরাং অভিষেকের জন্যে তৈরী হও। দুর্ভাগ্যবশতঃ তোমার বাবা হঠাৎ মারা গেলেন।
ভরত কিছুই বুঝতে পারছেন না। পিতার মৃত্যুসংবাদ শুনে শোকে অধীর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, ‘পিতা অসুস্থ আছেন—এ খবর আগে কেন আমায় জানাও নি? আমি বুঝতে পারছি না যে রামের মত উপযুক্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা থাকতে আমি কেন সিংহাসনে বসবো? তোমরা আমায় পাগল করলে—মা তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে?’
কৈকেয়ী স্নেহভরে পুত্রের কাধে হাত রেখে তাকে বর্ণনা করলেন কিভাবে মন্থরার চক্রান্তে নিরুপায় হয়ে রাজা কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে বাধ্য হন এবং কিভাবে রামের বদলে ভরত সিংহাসনের অধিকারী হন। ভরত এতক্ষণে সব বুঝলেন, রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেল। প্রথমেই ধাক্কা দিয়ে মাকে সরিয়ে দিলেন, চীৎকার করে বললেন, তুমি কি পাষাণ,কত নিষ্ঠুর, তুমি কি বুঝতে পারছো না যে তোমার জন্যেই আজ বাবা প্রাণত্যাগ করলেন? কিভাবে তুমি রামের এই ক্ষতি করতে পারলে? রাম কি তোমায় নিজের মায়ের মত মনে করেন না? সীতার মত ধর্মপ্রাণা নারীকে কত কষ্ট তুমি দিচ্ছ। তুমি কি ভেবেছ যে রাম- সীতাবিহীন এই রাজ্যে আমি রাজত্ব করবো? রামের সঙ্গে একমুহূর্তের বিচ্ছেদ যে তোমার পুত্রের কাছে অসহ্য তা কি তুমি জাননা। তুমি আমার মাতা নও। তোমার মুখদর্শন করাও পাপ। রামের চরণ ছাড়া আমার আর স্থান নেই। আমি এখুনি বনে যাচ্ছি রামকে ফিরিয়ে আনতে।’
একথা বলে ভরত সত্বর সে স্থান ত্যাগ করলেন। শত্রুঘ্ন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না—চুল ধরে মন্থরাকে প্রহার করতে আরম্ভ করলেন কারণ এই কুঁজী দাসীই যত নষ্টের মূল। পাছে নারীহত্যা হয় এই ভেবে ভরত তাড়াতাড়ি ফিরে এসে শত্রুঘ্নকে নিবৃত্ত করলেন।
এদিকে অনেক চিন্তা করে ঋষি বশিষ্ঠদেব ভরতকে ডেকে পাঠালেন প্রবীণদের সভায় এবং পুর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা বোঝালেন। তিনি ভরতকে রাজ্য শাসন করতে এবং রাম ফিরে এলে তাকে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে বললেন।
সভায় ভরত সব কথা শুনলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, “সকলের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। আপনাদের প্রস্তাবে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ক্ষমা করবেন—আমি রাজা হ’য়ে এখানে রাজ্য ভোগ করবো আর রামচন্দ্র সন্ন্যাসীবেশে বনবাস করবেন তা হতে পারেনা। আমার একান্ত ইচ্ছা আমি রামের চরণতলে পতিত হয়ে তাঁকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনবো। আপনারা সকলে রামকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমার সঙ্গে বনে চলুন। ভরতের ত্যাগ, জ্যেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃভক্তিতে সকলে মুগ্ধ, স্তম্ভিত।
রামকে ফিরিয়ে আনার আশায় সকলে উৎফুল্ল। ভরত মন্ত্রিমণ্ডলীকে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন এবং প্রয়োজন হলে বনেতেই রামের রাজ্যাভিষেকের কথা জানালেন।
প্রশ্নঃ
- অযোধ্যায় ফিরে এসে ভরতের কি প্রতিক্রিয়া হলো?
- ভরতকে রাজ্য শাসন করতে বলা হলে তিনি কি করলেন?