সুগ্রীবের সঙ্গে মিতালী
সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে রাম লক্ষ্মণ দক্ষিণদিকে যাত্রা করলেন। অরণ্যের একস্থানে পক্ষিরাজ জটায়ুকে মুমুর্ষু অবস্থায় দেখলেন, জিজ্ঞাসা করায় জটায়ু উত্তর দিলেন, ‘হে রাম, সীতাদেবীকে রথে চাপিয়ে রাবণ রাজা পলায়ন করছিল—আমি দেখেছি। আমি বাধা দিলাম ও যথাশক্তি তার সঙ্গে লড়াই করলাম। কিন্তু বৃদ্ধ আমি দুর্দান্ত রাবণকে পরাস্ত করতে পারলাম না। সে আমার ডানা কেটে দেয়, ফলে আমি এই স্থানে পতিত হয়ে আপনাকে সংবাদ দেবার জন্য অপেক্ষা করছি—সব কথা আপনাকে জানালাম। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারি।’ একথা বলেই জটায়ু প্রাণত্যাগ করলেন।
রাম লক্ষ্মণ জটায়ুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আবার যাত্রা শুরু করলেন। কয়েকদিন পর তারা পম্পানদী তীরে এলেন। এখানে তাঁদের সাক্ষাৎ হল সুগ্রীবের সঙ্গে। তিনি বানররাজ বালির অনুজ। বালি তাকে নির্বাসন দেন। সুগ্রীব ঋষ্যমূক পর্বতে সাময়িকভাবে বসবাস করছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর ও গুণী হনুমান। সুগ্রীব রাম লক্ষ্মণকে দেখে কিছু ভীত হলেন। ভয় হল যে তাঁরা বোধহয় অগ্রজ বালি কর্তৃক প্রেরিত। কিন্তু জ্ঞানী মন্ত্রী হনুমান তার ভয় দূর করে দিলেন।
তিনি অগ্রসর হয়ে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। রাম তৎক্ষণাৎ হনুমানের বিনয়, ধর্মভাব ও জ্ঞান লক্ষ্য করে তার প্রতি অনুরক্ত হলেন। রাম হনুমানকে বললেন, ‘আমরা সুগ্রীবেরই সন্ধান করছি। আমরা তার বন্ধুত্ব চাই। হনুমান এ কথায় পরম সন্তুষ্ট হলেন এবং তাদের পাহাড়ের চুড়ায় নিয়ে গেলেন। সুগ্রীব যথোচিত আতিথ্য দান করলেন। সানন্দে আসন গ্রহণ করার পর সুগ্রীব তার ভাই বালির সঙ্গে লড়াইয়ের কথা জানালেন। তিনি বললেন, আমরা উভয়েই একই পথের পথিক। সুতরাং আমরা পরস্পরের সাহায্য চাই।
সুগ্রীব তারপর বানর অনুচরদের সোনার গহনাগুলি আনতে হুকুম দিলেন। গহনাগুলি আকাশ হতে পড়ে যখন বলধৃতা এক রমণী রাক্ষস কর্তৃক অপহৃতা হচ্ছিলেন। অলঙ্কারগুলি দেখার সঙ্গে রাম মুর্চ্ছিত হলেন। লক্ষ্মণ পায়ের গহনাগুলি চিনতে পারলেন কারণ তিনি প্রত্যহ সীতাদেবীর পাদপূজা করতেন।
রামের মুর্চ্ছা ভঙ্গ হলো। সুগ্রীব রামের কাছে বালির শক্তির পরিচয় দিলেন। রাম বিশ্বাস অর্জনের জন্য মন্ত্রপূত এক বাণেরদ্বারা সপ্ততাল ভেদ করলেন। স্থির হলো সুগ্রীব বালিকে যুদ্ধে আহবান করবেন এবং যুদ্ধরত অবস্থায় রাম বালিকে বধ করবেন। যথাবিধি সুগ্রীব কিস্কিন্ধ্যায় গিয়ে বালিকে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন। তৎক্ষণাৎ বালি বাইরে এলেন এবং দুইভায়ে তুমুল যুদ্ধ হলো।
বালির হাতে অত্যন্ত নিগৃহীত হয়ে সুগ্রীব ফিরে এলেন। তিনি রামচন্দ্রকে দোষারোপ করলেন। কিন্তু রাম বললেন যে উভয় ভ্রাতার আকৃতি, পোষাক ও অস্ত্রাদি অভিন্ন হওয়ায় তিনি বালিকে চিনতে পারেন নি। তিনি বললেন, এবার তোমার ভাইকে যুদ্ধে আহান কর, তবে গলায় একটি ফুলের মালা পর যাতে তোমাকে আমি চিনতে পারি। রামের কথামত সুগ্রীব পুনরায় গিয়ে বালিকে যুদ্ধে আহান করলেন। বালি রাণীদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। তিনি উঠে পড়লেন দেখে তাঁর পত্নী তারাদেবী তাকে নিষেধ করলেন, বললেন—একটু আগে তোমার ভাই মার খেয়ে পালালো, আবার যুদ্ধে এল—আশ্চর্য্য—আশ্চর্য্য! মনে হয় কোন শক্তিশালী বন্ধু পেয়েছে। বালি এ আবেদনে কান দিলেন না। তিনি সুগ্রীবের সঙ্গে যুদ্ধে রত হলেন। রাম গাছের আড়াল থেকে বালিকে একটি বাণ মারলেন। বালির পতন হল। রাম লক্ষণ তৎসমীপে এলেন। বালি রামকে তাঁর ছলনার জন্য অভিযুক্ত করলেন। রাম বললেন, “তুমি ভায়ের রাজ্য বলপূর্বক গ্রহণ করে অধর্ম ও পাপাচরণ করেছ। তাই ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাকে হত্যা করা হল”।
রাম ও সুগ্রীব মিলনের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের দুটি বিভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই। একদিকে ভরত ও রামচন্দ্র, অপরদিকে বালি ও সুগ্রীব। উভয়ক্ষেত্রেই দুই ভাই এর মধ্যে ভাব-ভালবাসা ছিল। কিন্তু দুঃখ-বেদনায় রাম ভরতের গুণাবলী আরও বিকশিত হলো কিন্তু অবিশ্বাস ও লোভ বালিকে স্বৈরাচারী করলো। ফলে বালির পতন হলো।
প্রশ্নঃ
- রাম এবং সুগ্রীবের মানসিক স্থিতির মধ্যে কি সামঞ্জস্য ছিল?
- রাম ও ভরত; বালি ও সুগ্রীব – এই দুই ভ্রাতৃযুগলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করো।