বিষের বীজ
পুত্র-পুত্রবধূগণসহ রাজা দশরথ অযধ্যায় প্রত্যাবর্তন করলেন। চারদিকে শুধু আনন্দ। চার ভাই বিশেষতঃ রাম হলেন অযোধ্যাবাসীর নয়নের মণি। দশরথের সত্যিই বড় আনন্দের দিন। এইভাবে কিছুদিন কাটলো।
রাজার মনে ভবিষ্যতের চিন্তা—তার তার বয়স হয়েছে—এবার রামচন্দ্র সিংহাসনে বসবেন। গুরু বশিষ্টদেব এলেন—রাজার প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি জানিয়ে গুরুদেব ঠিক করলেন যে পরের দিন রামের শুভ অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হবে। দশরথ আদেশ দিলেন যেন সমস্ত ব্যবস্থা নিখুঁতভাবে হয়। খবর শুনে অযোধ্যাবাসীর আনন্দ আর ধরে না—সাগ্রহে তারা পরদিন প্রত্যুষের প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
এদিকে রাজ অন্তঃপুরে ঘটলো আর এক ঘটনা। রাণী কৈকেয়ীর দাসী মন্থরা রামের বিরুদ্ধে কৈকেয়ীর মনকে বিষিয়ে দিল। রাণী প্রথমে মন্থরার কু-পরামর্শে কর্ণপাত করেন নি কারণ সত্যিই তিনি রামচন্দ্রকে স্নেহ করতেন কিন্তু বিচিত্র মানুষের মন—আস্তে আস্তে কৈকেয়ী মন্থরার বশীভূত হলেন মন্থরা সব ব্যবস্থা করে দিল। এদিকে রাজা এলেন তাঁর প্রিয় রাণী কৈকেয়ীকে সুসংবাদ দিতে। কিন্তু কোথায় কৈকেয়ী? কেউ তো তাকে অভ্যর্থনা জানালো না। অবশেষে ক্ষুদ্র একটি কক্ষে দেখতে পেলেন এক কোণে কৈকেয়ী ভূমিশয্যায় শায়িতা। তবে কি রাণী অসুস্থ? কোন উত্তর নেই। অনেক সাধ্যসাধনার পর কৈকেয়ী বললেন—“মহারাজ, মনে আছে কি একবার আপনি আমায় দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন আর আমি বলেছিলাম যে সময় হলে চেয়ে নেব এখন সেই সময় এসেছে।”
রাজা সরল মনে বললেন—এই কথা—এর জন্যে এত চিন্তা? তুমি চাইলেই আমি বর দিয়ে দেবো। এবার কৈকেয়ী প্রার্থনা করলেন ভয়ংকর দুটি বর-প্রথম বরে তাঁর পুত্র ভরত হবেন অযোধ্যার রাজা, আর দ্বিতীয় বরে রামকে চোদ্দ বছরের জন্যে বনে যেতে হবে। দশরথ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, মুখে কথা সরছে না। তবু অনেক কষ্টে বললেন, ‘রাম তোমার কি করেছে? সে তো একটি পিঁপড়েরও ক্ষতি করে না। তুমি কি জান না যে প্রাণপ্রিয় রামকে ছেড়ে আমার প্রাণ থাকবে না। তাই অনুরোধ করছি—তুমি অন্য বর চাও। কিন্তু কৈকেয়ী তার প্রতিজ্ঞায় অচল। নিরুপায় রাজা রাণীর পায়ে ধরতে গেলেন—কিন্তু তাতেও ফল হলো না। রাণী জানালেন যে রাম যদি রাজা হয় তিনি তাহলে বিষপান করবেন। রাজা পড়লেন উভয় সংকটে—একদিকে রাম, অন্যদিকে ধর্ম।
অবশেষে তাঁর সত্যনিষ্ঠাই জয়ী হলো। বললেন, ‘তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। প্রিয় রামের নাম করতে করতে আমি প্রাণ ত্যাগ করবো’—এই বলেই রাজা মুর্ছিত হয়ে কৈকেয়ীর পায়ে পড়লেন।
উষার আলো ফুটে উঠলো। অযোধ্যাবাসী সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছে কখন অভিষেক শুরু হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। কৈকেয়ীর কক্ষে রামকে ডাকা হলো। সেখানে এসে পিতার অবস্থা দেখে রাম উদ্বিগ্ন হলেন। শান্তস্বরে কৈকেয়ী রামকে বললেন, “প্রিয় পুত্র, তুমিই একমাত্র পার তোমার বাবার এ যন্ত্রণা দূর করতে।’ রাম উত্তর দিলেন, ‘মাতা, পিতার আনন্দের জন্যে আমি যেকোন কাজ করতে প্রস্তুত—আদেশ করুন।’ এবার কৈকেয়ী তার সেই ভীষণ দুটি বরের কথা জানালেন যে বর দুটি দিতে রাজা অঙ্গীকারবদ্ধ।
রাম শান্তভাবে সব কথা শুনলেন এবং জানালেন যে ফল যাই হোক না কেন পিতার ইচ্ছে পূর্ণ করা তার কর্তব্য। পিতা ও মাতা কৈকেয়ীকে প্রণাম করে রাম এবার সরাসরি উপস্থিত হলেন কৌশল্যার কক্ষে। সেখানে অপেক্ষা করে আছেন সুমিত্রা, সীতা, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন। রাম শান্তভাবে দুঃসংবাদটি সবাইকে শোনালেন। শুনেই কৌশল্যা জ্ঞান হারালেন। রামের যত্নে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান ফিরলো। অনেক তর্কবিতর্কের পর ঠিক হলো যে সীতা ও লক্ষ্মণ রামের সঙ্গে বনে যাবেন। সবাই কৈকেয়ীকে দোষারোপ করতে লাগলো কিন্তু রাম বললেন, “দোষ দেওয়া ঠিক নয় কারণ তিনি তাঁর পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করতে চলেছেন কাজেই এতে কোন দুঃখ নেই।”
শেষ পর্যন্ত রাজা দশরথ আদেশ দিলেন যে পুরো অযোধ্যা নগরী রামের সঙ্গে বনে যাবে যাতে সেখানে তিনি রাজকীয় সুখ ভোগ করতে পারেন। কিন্তু রাম বাধা দিলেন ভরত তাহলে এই শূন্য নগরে—পরিত্যক্ত প্রাসাদে কিভাবে থাকবেন।
এবার বনগমণের পালা। রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা বল্কল পরিধান করলেন। রাজার আদেশে সুমন্ত তাদের রথে ওঠালেন। সে এক নিদারুণ দৃশ্য—সবাই শোকমগ্ন, অযোধ্যাবাসী বিলাপ করছে, তার মধ্যে দিয়ে রথ অযোধ্যা ছেড়ে চলে গেল।
কৌশল্যা অভিযোগ করলেন যে রাজা তাদের প্রাণাধিক রামকে বনে পাঠিয়ে দিলেন। এই সময় রাজার মনে পড়ে গেল অতীতের এক ঘটনা। তিনি রাণীকে সেই শ্রবণকুমারের কাহিনীটি বর্ণনা করে বললেন যে আজ যা ঘটছে তা হচ্ছে তার অতীত কর্মের ফল যদিও নিজের অজান্তেই সে ভুল তিনি করেছিলেন।
ঘটনাটি হলো, কোন এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় রাজা দশরথ বনে গিয়েছিলেন শিকার করতে। তিনি ছিলেন সুদক্ষ তীরন্দাজ। হঠাৎ শুনতে পেলেন শব্দ—যেন একটি হাতী জলপান করছে—সেই শব্দ লক্ষ্য করে রাজা তীর ছুঁড়লেন—সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন মানুষের আর্তস্বর—হায় পিতা-মাতা, আমি চলে যাচ্ছি। ব্যথিত রাজা ঘটনাস্থলে ছুটে এসে দেখলেন এক কিশোর ঋষিকুমার পুষ্করিণীর তীরে যন্ত্রণায় চীৎকার করছেন, তিনি বললেন, ‘মহারাজ, কেন আপনি আমায় হত্যা করলেন, আমিতো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। আমি এসেছি আমার অন্ধ পিতামাতার জন্য জল নিতে—তারা আমার অপেক্ষায় আছেন। আমাকে হারানোর ব্যথা তারা সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু আমার সময় হয়ে আসছে। আপনি যান এবং তাদের জল দিন আর তাদের কাছে ক্ষমা চান।’
রাজা দশরথ দ্রুতপায়ে জল নিয়ে বৃদ্ধদম্পতীর কাছে এলেন এবং তাদের পায়ে পড়লেন। রাজা বললেন, আমি আপনাদের পুত্র নই। আপনার পুত্রকে ভুল করে হত্যা করে, আমি মহাপাপ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।
একথা শুনে বৃদ্ধদম্পতী জ্বলে উঠলেন, বললেন, সত্যিই তুমি মহাপাপ করেছ যদিও অজান্তে। তোমাকেও একদিন পুত্রহারা হয়ে আমাদের মত যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।
এ কাহিনী কৌশল্যাকে বর্ণনা করে রাজা মন্তব্য করলেন ‘আমি শুধু আমার কৃত কর্মের ফল ভোগ করছি।’