দীপাবলী উৎসবের তাৎপর্য
আলো বা ঔজ্জ্বল্য জয়ের চিহ্ন, শত্রুর ওপর ও সুখী জীবনযাপনের পথে আসন্ন বাধার ওপর বিজয় ঘোষনা। আনন্দের বহি:প্রকাশের মাধ্যমই আলো। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দীপাবলী উৎসবের উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। উত্তর ভারতের গল্প অনুসারে দীপাবলী উৎসব শুরু হয়েছিল সেদিন, যেদিন দীর্ঘকাল বনবাসের পরের ও রাক্ষস কালকে ধংস করার পরে রাম সীতা ও লক্ষন বিজয় গৌরবে অযোধ্যায় ফিরে এল। ভারতবর্ষের অন্যান্য অনেক অঞ্চলে এই আলোক উৎসবের সম্পর্ক রয়েছে শ্রীকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী সত্যভামার হাতে নরকাসুরের বিনাশ ও ধংসের সাথে। আবার আরও কিছু কিছু অঞ্চলে এরকম ভাবা হয় রাক্ষসরাজ বলি রাজার অহংকারের দমনের পর বামন অবতারের তার ওপর আশির্বাদ বর্ষনকে মহিমান্বিত করতেই এই দীপাবলী উৎসবের উদ্যাপন। কিন্তু কাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও তাৎপর্যপূর্ণ কাহিনী হল সেটাই যেখানে নরকাসুর ও তার পতনের কথা বলা হয়েছে। তার নামই বলে দেয় যে সে নরককেই উচ্চাসনে বসিয়েছে। সবরকম পাপ কাজ ও কলঙ্কিত অধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সে ব্যস্ত ছিল। তাই তার নিজের মা ধরিত্রিদেবী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি নরকাসুর ও তার দুষ্ট রাক্ষস দলকে সমূলে নিধন করেন।
এই আলোর উৎসবের দিন সবাই খুব ভোরে ওঠে ও তাদের বাড়ির সর্বত্র ও রাস্তা বরাবর প্রদীপসজ্জায় আলোকিত করে তোলে এই বার্তা ঘোষনা করার জন্য যে দানব প্রভাবিত তমসাছন্ন দিনের অবসান ঘটেছে। তারা সেদিন শুদ্ধাচারে স্নান সেরে নতুন পোশাক পরিধান ক’রে আলো বাজি ঝকমকে আলোকসজ্জা ঘিরে নাচ গান ও আনন্দে মেতে ওঠে।
নরকাসুর নির্দেশ করে মানুষের অধঃপতিত হবার প্রবণতাকে এবং দীপাবলী উদযাপন করে এই অশুভ প্রবণতার ওপর মানুষের বিজয় ঘোষনা। নরকাসুরের রাজধানীর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর যা আক্ষরিক অর্থে তার মৌলিক দোষত্রুটিকেই প্রকাশ করে। কারণ প্রাগজ্যোতিষপুর মানে হল সেই নগর যেখানে মানুষ তার সনাতন শাশ্বত আলো ও আত্মার মহিমা ও ঔজ্জ্বল্য সম্পর্কে সচেতন নয়। সেই নাগরিকেরা বিশ্বাস করে শরীরে ও ইন্দ্রিয়জাত কামনা ও শারীরিক প্রবণতায় যা অহংকার আবেগজাত তাড়না ইত্যাদির উৎস। নরকাসুর ধরিত্রী মায়ের সন্তান। সব মানুষই সেই একই ধরিত্রী মায়ের সন্তান এবং সেই কারণে সব মানুষের মধ্যেই একটা নিম্নগামী টান বা আকর্ষণ রয়েছে যে টানের জন্য নরকাসুর স্বয়ং যন্ত্রণা ভোগ করেছে।
নরকাসুরের গল্পটা তাই মানবকুলের প্রতি একটা পরীক্ষিত দৃষ্টান্ত ও সতর্কবাণী। ভগবান এই অসুর বংশ সমূলে ধ্বংস করেছিলেন সত্যস্বরূপ তার স্ত্রী সত্যভামাকে পাশে নিয়ে। এই অধ্যায়টি এই অর্থবহ শিক্ষায় সমৃদ্ধ যে সত্যই হল অশুভকে পরাভূত করার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র। শ্রীকৃষ্ণ হলেন প্রেমস্বরূপ ও তার ছায়া হল সত্য। তারা দুজনেই অভিন্ন ও একে অপরের পরিপূরক। দীপাবলী সম্পর্কে উত্তরভারতে প্রচলিত জনপ্রিয় গল্পটিরও একটা গভীর অর্থ রয়েছে। অযোধ্যা মানে হল সেই নগর যা কখনোই শত্রুকবলিত হয়না অর্থাৎ অযোধ্যা বলতে স্বয়ং আত্মাকে বোঝান হচ্ছে। কিন্তু চোদ্দ বছরের জন্য অযোধ্যা তমসাচ্ছন্ন ছিল যখন রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন। রাম কথাটির অর্থ হল যা আনন্দ দেয় এবং এই আনন্দের চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিছুই হতে পারেনা। সেইজন্যই কোনও মানুষকে উল্লেখ করতে গেলে আমরা আত্মারাম বলে সম্বোধন করে। আমরা কখনোই আত্মাকৃষ্ণ বা আত্মাশিব শব্দগুলো ব্যবহার করিনা। এটা সবসময় আত্মারাম কথাটিই বলি। যখন রাম ফিরে এলেন তখন যেন বাস্তবিকই অযোধ্যার নবজন্ম হল। এটা ছিল এই স্বত:স্ফুর্ত আনন্দের উৎসব। সীতা অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় আনন্দমুখর করে তুলেছিলেন।
সীতা হলেন রামের ছায়া এবং তিনি শান্তির মূর্ত প্রতীক এবং রাম হলেন ধর্মের প্রতীক। এভাবেই অযোধ্যা নগরীতে শান্তি ও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। সেই দিনটি ছিল আলোর উৎসব। এই দীর্ঘ আলোর সারি ও ঘরের দরজায় দরজায় ঝুলন্ত ক্ষুদ্র প্রদীপ দিয়ে তৈরী অত্যন্ত উজ্জ্বল আলকমালা এক গভীর প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে। কারণ এইসমস্ত প্রদীপগুলোই একটা মুল প্রদীপ থেকে আলোকপ্রাপ্ত হয়, ঠিক যেমন লক্ষ লক্ষ স্বতন্ত্র প্রাণ একটিমাত্র প্রণের উৎস থেকে উদ্ভূত হয়। প্রত্যেকটি প্রদীপ বা আলো একটি পরম জ্যোতি থেকেই আলোকপ্রাপ্ত হয়, কোনও প্রদীপের আলোই তার জ্যোতি বা ঔজ্জ্বল্য এবং আলোকিত করার শক্তি হারায় না। এটাই হল সব বিরাজমান দিব্য নীতির শিক্ষা যা দীপাবলী আমাদের প্রদান করে।
সেই পরম জ্যোতির ধ্যান কর যা থেকে তোমার হৃদয় শক্তি আহরণ করে ও আলোকিত হয়; তুমি হলে সেই শাশ্বত মহাজাগতিক আলোর একটি স্ফুলিঙ্গ মাত্র। যখন তুমি এটা উপলব্ধি করতে পারবে তখন তুমি অন্ধকার থেকে আলোতে পরিচালিত হবে।
পৌরাণিক কাহিনী
উত্তরভারতে এরকম বিশ্বাস করা হয় যে দীপাবলীর দিন শ্রীরাম চন্দ্র বনবাস থেকে ফিরে এসে অযোধ্যার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। আরেকটি কাহিনীতে উল্লেখ আছে যে এইদিন শ্রীকৃষ্ণ তার স্ত্রী সত্যভামাকে সাথে নিয়ে নরকাসুর নামের ভয়ংকর অসুরকে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। দানব নরকাসুর ছিল প্রচন্ড অত্যাচারী ও সে সাধু ও বয়োজেষ্ঠদের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল ছিল না। রাজ্য বা ভূমিজয়ের লালসা তার মনকে নিপীড়িত করে। বিনা বিচারে সে লুটতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম চালাত। সে মহিলাদের অপহরণ করত তার অপরাধ ও পাপকাজের জন্য সে একটুও অনুতপ্ত ছিল না। যখন অসহয় ভাল মানুষেরা তাদের পরিত্রাণের জন্য কৃষ্ণের সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন কৃষ্ণ নরকাসুরের রাজধানী আক্রমন করলো ও তার স্ত্রী সত্যভামাকে নির্দেশ দিল সেই দানবকে হত্যা করতে। নরকাসুরের নগরকে বলা হত প্রাগজ্যোতিষপুর। সেই দানব ছিল পৃথিবীর পুত্র।
উপরোক্ত কাহিনীর তাৎপর্য নরকাসুর প্রতিনিধিত্ব করেছেন অজ্ঞতাকে, আত্মার মহিমা সম্পর্কে অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতা একজনকে পরিচালিত করে এই বিশ্বাসে যে সে শুধুই শরীর ও শারীরিক যাবতীয় প্রয়োজন কামনা বাসনা বিক্ষোভ মেটানোই তার কাজ। যখন একজন মানুষ শারীরিক শক্তিতে, অর্থ বলে বুদ্ধি ও পান্ডিত্যে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয় কিন্তু আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হয় না সে তখন সমাজের পক্ষে মূর্তিমান বিপদ হয়ে দাঁড়ায় ও নিজের সে কারণ সে নিজেই হয়। তার প্রতিবেশি ও আত্মীয়দের কাছে সে একজন মুর্তিমান নরক। সে শুধু বহুকে দেখতে পায় কিন্তু সেই পরম এক কে দেখতে পায়না। নানাবিধ বাহ্যিক চাকচিক্য আকর্ষিত হয়ে পক্ষপাতদুষ্ট নিম্নগামী পথে তার স্খলন ঘটে। তাদের কোন শুভ অন্তর্দৃষ্টি বা চেতনা ছিল না যা তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। তার অন্ধকারেই ঘোরাফেরা করত। তারা বুঝতেই পারত না যে তারা সেই পরম জ্যোতি বা চেতনার আলো সম্পর্কে অচেতন।
অজ্ঞানতা একমুখী চিন্তায় যখন গভীরভাবে তমসাচ্ছন্ন তখন সত্যের দীপ্তির এক ঝলকেই সে ধংস হয়। লোভ ও লালসা, ঘৃণা ও হিংসা, অহংকার ও আত্মন্তরিতার মতো আসুরিক প্রবৃত্তি প্রতিটি মানুষের মধ্যে লেলিহান অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। শুধুমাত্র জপ ও ধ্যানের মধ্য দিয়ে আত্মসংযমের দ্বারা এই আগুনকে নির্বাপিত করা যায় ও বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা যায়। আজ আমরা নরকাসুরের নামের সাথে সম্পর্কিত বিশেষ লক্ষণ বা বৈশিষ্টগুলোকে ধুংসের মধ্য দিয়ে দীপাবলী উৎসব উদযাপন করি। কারণ সেইসব আসুরিক প্রবৃত্তির মিলিত প্রয়াস মানুষকে নরকে পতিত করে।
অন্তর্নিহিত তাৎপর্য: আমাদের মনোযোগ দিতে হবে জীর্ণ অর্থহীন পক্ষপাত ও কুসংস্কার খারিজ করার প্রতি এবং আত্মীয়দজন ও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভাইবোনকে ভালবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার প্রতি। আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠা বন্ধুত্ব সৌভ্রাতৃত্ব সমধর্মীতার পুষ্পমালা দিয়ে সাজিয়ে তুলতে হবে। আত্মম্ভরিতা ও অন্তসারশূণ্য উল্লাস স্মৃতির উৎসবের পরিবর্তে এভাবেই এই আলোর উৎসব অর্থবহ ও সফল হয়ে উঠবে।
পরম জ্যোতি এই জ্যোতি শুধুমাত্র জ্ঞানের আলো নয়। এই আলো সেই পরম চৈতন্যজ্যোতির চিহ্নস্বরূপ যে আত্মা আলোরূপে প্রতিটি প্রাণে বিরাজমান। একটি। প্রদীপ থেকে যেমন সহস্র প্রদীপ জ্বালানো যায় এবং লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালানোর পরেও সেই আলোকদায়ী প্রলীপটির শিখা ঠিক একইরকম উজ্জ্বল থাকে। ঠিক এইভাবেই পরমাত্মা জীবাত্মা বা জীবজগতকে আলোকিত করে একই ভাবে জাজ্জ্বল্যমান থাকে।
তমসো মা জ্যোতির্গময়ো – হে ঈশ্বর আমাকে আঁধার থেকে আলোয় নিয়ে চলো। হে ঈশ্বর আমাকে অজ্ঞানতার অন্ধত্ব থেকে সত্যের আলোকিত অন্ত্দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত করো কারণ সেই আলোতে সত্যের প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিটি মানুষকে প্রথমে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে জীবনকে কি ভাবে সে মূল্যবান করে তুলবে। এবং ঠিক কি পাবার জনা সে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হবে সেই কারণে প্রত্যেকে তাদের গুরুজন যারা সত্যের আলোকিত পথ ধরে অনেকদুর ভ্রমন করেছেন তাদের সাথে দেখা করবে ও তাদের সাথে আলোচনা করবে। এবং তাদের অভিজ্ঞতার উদাহরণে অনুপ্রাণিত হয়ে একাগ্রচিত্তে তাদের নির্দেশিত পথে সাধনায় ব্রতী হবে। যখন মানুষ তার সাফল্যের দ্বারা জনসাধারণের কলানসাধনে বার্থ হয় তখন সে নরকাসুর পরিণত হয়।
ধনলক্ষী: যখন কোন মানুষ ধন সম্পদ লাভ করে তখন সেই সম্পদের প্রতি তাকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কারণ বিশ্বাস ও ভরসার সাথে তাকে তা দেওয়া হয়েছে। তাই অবশ্যই সে সেই অর্থ ব্যবহার করবে সমাজের উন্নতি সাধনে, ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি সাধনে নয়।
দীপাবলী প্রেম ও আলোর পাঠ দান করে – ভালবাসা একাই আলো দিতে পারে, সেই আলো চতুর্দিকে ছড়িয়ে যায়, বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত আলো একে অপরের সাথে মিলেমিশে যায়। আলো গন্ডীবদ্ধ নয়। আলোর কোন পক্ষপাত নেই, প্রিয় অপ্রিয় নেই। আলো শুধু চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে জানে, আপন পর ও জাতিধর্মের ভেদজ্ঞান উপেক্ষা করে প্রসারিত হয়, প্রবাহিত হয় অসীম ভালবাসার এক অবিরাম ধারায়। সকল আধ্যাত্মিক সাধনার এটাই সর্বোচ্চ সীমা।
যখন প্রেমের প্রদীপ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয় তখনই ঈশ্বরের দেখা মেলে। ঈশ্বরর আমাদের বারবার বলে থাকেন – এই আলোকশিখাকে পবিত্রতায় ও উজ্জ্বলতায় সদা প্রজ্জ্বলিত রাখতে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ সবার উপর বর্ষিত হয়, ঈশ্বর সকলকে অনুমতি দিয়েছেন এই দিব্যজ্যোতি থেকে সকলের হৃদয় আলোকিত করার।
“সেবার ভ্রুণেই ভালবাসা জন্ম নেয়”
[সত্য সাই স্পিকস, পঞ্চম খন্ড, পৃষ্ঠা – ২৯২]
‘আমি দীপাবলী উদযাপন করতে বলেছি ভুরিভোজন করে বা সশব্দে বাজি পুড়িয়ে প্রতিবেশীদের সুখশান্তি বিঘ্নিত করার জন্য নয়, আমি এই আলোর উৎসব পালন করতে বলেছি প্রেমের সাথে নিঃশব্দে সেবা করে ও নীরবে প্রদীপ জ্বালিয়ে’
[বাবা, সত্য সাই স্পিকস, পঞ্চম খন্ড; পৃষ্ঠা- ২৯২]